Saturday, April 8, 2017

মন বলে ফিরে চল পহেলা অগ্রহায়ণে


বাঙালির ইতিহাস চার হাজার বছরের। আর বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস মাত্র সেদিনের !

বাংলা সন ও পহেলা বৈশাখ শিরোনামে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত (১৪ এপ্রিল ২০১১) ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্যের লেখায় পাই "বাংলা বছরের পঞ্জিকায় যে ১২টি মাস বর্তমান, তার ১১টিই নক্ষত্রের নামে নামাঙ্কিত। এ ক্ষেত্রে 'বৈশাখ' বিশাখা নক্ষত্রের নামে, 'জ্যৈষ্ঠ' জ্যাষ্ঠা নক্ষত্রের নামে, 'আষাঢ়' আষাঢ়ার নামে এবং এরূপ শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র যথাক্রমে শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদা, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, পৌষী, মঘা, ফাল্গুনী ও চিত্রার নামে অঙ্কিত হয়েছে। যে মাসটি নক্ষত্রের নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, সেটি হচ্ছে অগ্রহায়ণ; আর এই নামটির সঙ্গেই মিশে আছে বাংলার কিছু ইতিহাস, কিছু স্মৃতি এবং কিছু বিস্মৃত হয়ে যাওয়া তথ্য।


'অগ্র' শব্দের অর্থ প্রথম, আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ বছর। বছরের প্রথম বা অগ্রে অবস্থান করার কারণে নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন একমাত্র মাসটির নাম হচ্ছে অগ্রহায়ণ। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ মতান্তরে ১৫০০ বছর আগে প্রণীত শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় মাস হিসেবে অগ্রহায়ণ মাসটির উদ্ধৃতি রয়েছে (১০ম অধ্যায় : ৩৫ নম্বর শ্লোক)। অবশ্য সেখানে প্রিয় ঋতু হিসেবে বর্ণিত আছে বসন্তকালের নাম। বাংলার এই মাস ও ঋতুগুলো যে বহুপূর্বকাল থেকে ভারতবর্ষে প্রচলিত, উপযুক্ত তথ্য মূলত তারই পরিচায়ক।"

ড. মুহম্মদ এনামুল হক আমাদের জানাচ্ছেন, প্রায় প্রাচীন কাল থেকেই এ অঞ্চলে নববর্ষের উৎসব পালন হয়ে আসছে। তিনি নববর্ষের আদি অনুষ্ঠান হিসেবে ‘আমানি’ উৎসবের কথা বলেছেন। এটি ছিল মূলত কৃষকের উৎসব।

সম্রাট আকবরের সময় থেকে 'বৈশাখ' মাস বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে করা হয়। তবু বৈশাখকে বছর শুরুর মাস আর পহেলা বৈশাখকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন শুরু করতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। বলা হয়, আকবরের অনেক পরে রচিত বাংলা সাহিত্যে, বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখের উল্লেখ নাই।

"ইংরেজ আমলে রবীন্দ্রনাথদের পরিবারে পাশ্চাত্য নববর্ষের অনুসরণে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। পরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের ব্যবস্থা করেন। কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারেও এভাবে ধীরে ধীরে বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে কিছু উৎসাহ-উদ্দীপনার খবরাদি পাওয়া যায়।"

"পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন কেন্দ্রীয় সরকারের বাধার মুখে পড়ে। তারা একে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে আখ্যায়িত করে। বাঙালি পণ্ডিতেরা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখের নেতৃত্বে সম্রাট আকবর যে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, সেটি বলেই বাঙালির নববর্ষকে বাধাগ্রস্ত না করার আহ্বান জানান। পাকিস্তান সরকার সেই দাবি অগ্রাহ্য করে। এ রকম একটি অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’ (১৯৬১) নামক আজকের খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক সংগঠনটি। এই সংগঠন ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে নিয়মিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির নানা আঙ্গিকে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্যভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে শুরু করে। সেই নববর্ষ উৎসব প্রতিবছরই বিশাল থেকে বিশালতর হতে থাকে। এখন সেই অনুষ্ঠান বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। " (বাংলা, বাঙালি ও বাংলা সন :শামসুজ্জামান খান)

তো দেখা যাচ্ছে আত্মবিস্মৃত বাঙালি কথাটা একেবারে ফেলনা নয় । আমাদের নববর্ষ ভুলিয়ে দিয়েছে বিজয়ী শাসকরা। আমাদের অনেক কিছুই তারা ভুলিয়ে দিয়েছে। আমরাও হয়তো ইচ্ছা করেই ভুলে গেছি অনেক কিছু।

এখন সময় এসেছে আত্মপরিচয় খুঁজে বের করার। আমাদেরকে মূলে ফিরতে হবে। বাঙালিয়ানায় ফিরতে হবে। অগ্রহায়ণে ফিরতে হবে। নিজেদের ভুলে যাওয়া ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে।

লেখক: মৃন্ময় মিজান, আবৃত্তিশিল্পী ও সংগঠক


(১৫.০৪.২০১৩)

No comments:

Post a Comment