আজকের বিকেলটা ছিলো ছবির মতো সুন্দর। কংস নদীর সর্পিল বাঁকের দিকে চোখ পড়তেই মন চলে গেলো শৈশব-কৈশরের হারানো বাঁকের দিকে। নদীর মতোই মানুষের জীবন বাঁকে ভরা ও সতত বহমান। নদীর স্বচ্ছ তির-তির বয়ে যাওয়া জলে জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু সেই জলছবি মূর্ত হয়ে ওঠার আগেই দীর্ঘশ্বাস হয়ে হারিয়ে যায় স্রোতের মতো।
কংস নদীর প্রবাহমান শরীর এত্ত সুন্দর আর তার তীরঘেঁষে সবুজের এত্ত সতেজ সমারোহ, দেখেই মুগ্ধতায় ভরে গেলো মন। বারবার এই সৌন্দর্য উপভোগের আকাঙ্খা নিয়েই ফিরে যায় হয়তো সবাই। কিন্তু আমরা এমন অগণন পরিবেশ-প্রতিবেশের ঘ্রাণ নিয়েছি, এমন অনেক সুন্দর স্থান মাড়িয়েছি যেসব হয়তো দ্বিতীয়বার আর ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হবে না। আবার ফিরে যাবার অনুভুতি নিয়ে ফিরে এলেও আর ফিরে দেখার ফুরসত দেয় না সময়। মনে হলো, ‘এই পথ যে চলার পথ, ফেরার পথ নয়।’ কংস নদীর মতো জীবনের বাঁক সময়গুলো কেড়ে নিলেও ভালোলাগা অনুভুতি তো কেড়ে নিতে পারে না। এই আমাদের সান্ত্বনা, এই প্রাপ্তি, এটাই এক জীবনে আমাদের সঞ্চিত সম্পত্তি।
এসেছি ‘মহুয়া‘ পালার সেই বিখ্যাত কংস নদী দেখতে। নেত্রকোণা শহরে অদূরে বড়ওয়ারী (বড়াইল) ব্রিজে দাঁড়িয়ে এ নদী দেখে অসম্ভব ভালোলাগা সঞ্চারিত হয়েছে দেহ-মনে। নদীর বাঙময় শরীর এবং এর আশপাশের সুন্দর দৃশ্য সতিই মোহিত করে। সাহিত্যের এত উপাদান এখানে, কল্পনাতীত। তাইতো কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ ও হেলাল হাফিজগণ এত সতেজ সাহিত্যাঙ্গনে। বলছিলাম কংস নদীর কথা। তবে এখানে যাদের অাতিথেয়তায় আপ্লুত হয়েছি তাদের কথা একটু বলে নিই মাঝখানে।
পড়ন্ত দুপুরে আমার স্টুডেন্ট মির্জা মৌ‘র বাসায় ভুরিভোজ শেষে ঘুরতে বেরুলাম। আন্টি-আংকল (মৌ‘র মা-বাবা) এত অমায়িক ও স্নেহশীল, যা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। আন্টি শিক্ষকতা করেন আর আংকল নেত্রকোণা শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাঁরা শুধু আমাকে আপ্যায়িত করেই ক্ষান্ত হননি, ফেরার সময় নেত্রকোণার বালিশ (বড় সাইজের স্থানীয় বিখ্যাত মিষ্টি) ও নিজেদের গাছের কাঁঠাল প্যাকেট করে নিয়ে আসতেও বাধ্য করেছেন। সাদমান তাঁদের একমাত্র ছেলে, ক্লাস এইটে পড়ে। মৌ‘র বন্ধু অর্ণব, ঢা.বি.তে বিবিএ (ফিন্যান্স) শেষ করে এমবিএ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্ণবের ক্যামেরার ল্যান্স আমাদের এই বিকেল ভ্রমণের অম্লান মুহূর্তগুলো স্থির করে নিয়েছে। মৌ, সাদ আর অর্ণব। আমরা এ চারজন ভ্রমণ কাফেলার সদস্য।
অল্প সময়ের এ কংস নদী দেখার মুগ্ধ অনুভুতিগুলো সারাজীবন হৃদয়ে ধরে রাখার মতো। ফেরার সময় মনে হতে লাগল, কেন এত দ্রুত সন্ধ্যা নেমে এলো! যদি বিকেলটা আরেকটু দীর্ঘ হতো! তখনি মনে হলো, জীবন তো এমনই একটা সময় সন্ধ্যার আবীরে মিলিয়ে যাবে। কংস নদীর দৃশ্যমান বাঁকের পর কী আছে আমরা যেমন জানি না। তেমনি আমাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে কী অপেক্ষা বা প্রতীক্ষা করছে, তাও জানি না। তবু জীবনকে বলবো, ‘তুমি আমাকে প্রতীক্ষা করতে বলো, আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে।‘
আজই সকালবেলা ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোণা এসেছি। উদ্দেশ্য বোন ও ভগ্নিপতিকে দেখে যাওয়ার পাশাপাশি একটু বেড়িয়ে যাওয়া। সকালবেলা এসেই শালিতো বোনের হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। তারপর নিক্সন, মাহফুজা, মাসুমা, লুবনা ও ইমার সাথে কিছু সময় গল্প করলাম। এরমধ্যে মুন ফোন করে বলল, তার ভাই নাঈমকে পাঠিয়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের গ্রামে যেতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই শহরের মোক্তারপাড়া থেকে বেরিয়ে পড়লাম হাটখোলার উদ্দেশ্যে।
শ্যামলী বাংলার গ্রাম দেখতে কার না ভালো লাগে। আর আমার মতো ভ্রমণপিয়াসী ও সংস্কৃতি কর্মী তো এমন সুযোগ কোনোভাবেই মিস করবে না -এটাই স্বাভাবিক। নদী-হাওর বিধৌত একটি গ্রাম দেখার আগ্রহ ছিলো। আর এ আগ্রহকে বাস্তবে রূপায়ন করতে সবকিছু বন্দোবস্ত করে রেখেছে আমার নবীন স্টুডেন্ট ফারিয়া মুন। মুনের বড় ভাই নাঈম, নেত্রকোণা সরকারি কলেজের বিবিএ (সম্মান) এর শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে ব্যাটারি চালিত রিক্সায় চড়ে বসলাম। নির্মল হাওয়া খেতে খেতে শহরের উপকণ্ঠ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঞ্চণপুর গ্রামে। ২০০৪ সালে এক টর্নেডোতে এ কাঞ্চনপুর গ্রাম পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলো। এ ক‘বছরে কাঞ্চণপুর বাংলার চিরায়ত সবুজ গ্রামের মতো রূপসী হয়ে উঠেছে আবার। রাস্তার ধারে গাছের সারি বাতাসে সাথে হেলেদুলে নাচছে। দু‘পাশে ফসলের মাঠ, মাঝে মাঝে বিল-হাওর। কী সুন্দর গ্রাম।
তারপর কাঞ্চণপুর পেরিয়ে আমরা চলে গেলাম হাটখোলা। ‘গাঁয়ের নামটি হাটখোলা, বৃষ্টি-বাদল দেয় দোলা, বকের সারি কোথায় রে, লুকিয়ে গেলো কাশবনে।‘ এমনই কবিতার মতো গ্রাম। নিড়ানো জমির মাঝ দিয়ে আল। আল পেরিয়ে এক অবস্থাপন্ন গেরস্থ বাড়িতে উঠলাম। স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক হালিম মাস্টারের বাড়ি। হালিম মাস্টার মুনের বাবা। আমার গুণধর ছাত্রী নিজ হাতে রান্না করেছে নানা পদের খাবার। আংকল ও আন্টির (মুনের বাবা-মা) পরিবেশনায় আমাকে অনেক কিছুই খেতে হলো। খেতে খেতে গ্রামের নানান আলাপ চলছিল। মাঝে মুনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নাসিম এসে সালাম দিয়ে গেলো।
বিদায় নেয়ার সময় গ্রামের সরলমনা মানুষদের নিখাদ ভালোবাসাময় উক্তি, ‘আবার আসতে হবে। যখনই এদিকে আসা হবে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে বেড়িয়ে যেতে হবে।‘ আরও কত হৃদয় নিংড়ানো আবদার ও প্রীতিময় উচ্চারণ। এসব আবেগঘণ মুহূর্তগুলো আমি কখনই ভুলতে পারি না। অবশেষে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একটি উপহার নিলাম। মুনের বড় মামার ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ‘কবির ৫০ | আহমেদ স্বপন মাহমুদ | ভাব ও বৈভবের বাউল‘ স্মারকগ্রন্থটি। এ গ্রন্থের মাধ্যমে একজন কবিকে জানা হবে। এরপর বের হয়ে এ পরিবারের প্রতিষ্ঠিত হলইদাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (নেত্রকোনা সদর) কিছু সময় কাটালাম। শেষে সম্মানীয় হালিম মাস্টার এবং স্নেহাষ্পদ নাঈম মোটরবাইকে করে শহরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে বিদায় দিলেন।
আবার গ্রাম দেখতে দেখতে শহরে ফিরে এলাম। সাদমান এসে নিয়ে গেলো নিউ টাউন বড় পুকুরের পাশে তাদের বাসায়। দিঘির মতো তিনটি বড় পুকুর এ এলাকায়। এসব পুকুরের পাশে বসে থাকলেও মনটা সতেজ হয়ে যায়। বাসার পেছনেই বিশাল বিল। বিলের জলজ বাতাস শরীরে স্নিগ্ধতা এনে দেয়। দুপুরের ভুরিভোজের পরই কংস নদীর তীরে বেড়াতে যাই, যা ইতোপূর্বে উল্লেখ্য। সন্ধ্যায় ফিরে আসি বৃষ্টিপূর্ব নির্মল বাতাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে। সবার নিকট বিদায় নিয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা করি। এ হলো নেত্রকোণার সংক্ষিপ্ত সময়ের বিখ্যাত সফর। সারাজীবন মনে রাখার মতো ভালো মানুষগুলোর সঙ্গে সময় কাটানো জীবনের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে র‘বে। আজকের দিন, ওহে নেত্রকোণা! তুমি, তোমরা র‘বে নীরবে হৃদয়ের গহীনে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment