Saturday, September 8, 2012

অতীতের প্রতিধ্বনি, প্রতিনিয়ত শুনি…

সময়টা ঠিক ভর দুপুর। ঘড়ির কাঁটায় ১২:৪৫। ভাদ্রের তাল পাকা গরম পুড়িয়ে দিচ্ছে চট্টগ্রাম শহর। বন্ধুর সাথে রিক্সায় চড়ে চকবাজার থেকে যাচ্ছি কাতালগঞ্জের দিকে। রাস্তার চওড়াকরণ কাজ চলছে। রিক্সা চলছে তাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রিক্সা এসে থামলো প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে। বন্ধুর নব পরিণীতা এখানকার টিচার। গতকালই (০৭.০৯.২০১২) তাদের বিয়ে দিলাম। চার মাসের সম্পর্কের নতুন নাম দাম্পত্য জীবন। দু’জনের ঐকান্তিক ইচ্ছায় আমরা কয়েকজন বন্ধু আয়োজন করি। দুই ফ্যামিলির কেউ এখনো জানে না। জানার পর কী হবে তাও জানি না আমরা কেউ। আমরা আপেক্ষা করছিলাম কাছাকাছি গাছের ছায়ায়। নাঈমা ট্রেনিং শেষ করে বের হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। একটি ফেলে রাখা রিক্সা-ভ্যানের উপর দু’জনে বসে পড়লাম।


ছায়াময় পথপ্রান্তে মৃদু বাতাস হঠাৎ মনটাকে উদাসী করে দিলো। মন চলে গেলো এক দশক পূর্বে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায়। জায়গাটা আর আগের মতো নেই। প্রথম তার সাথে যেখানে দেখা হয়েছিলো। তা আজ আর ঠাহর করতে পারলাম না। রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে অনেক বিল্ডিংয়ের সামনের অংশ ভেঙে ফেলেছে কর্তৃপক্ষ। দুপাশের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেক কিছুই চেনার উপায় নেই। তবে যেখানে বসে প্রথম নাস্তা করেছিলাম, সেই ফাস্ট ফুডের দোকান ‘টিটবিট’ এখনো আছে। কিছুটা নষ্টালজিক আক্রান্ত। তার হোস্টেল ছিলো এখানে। তখনো সামনা-সামনি কথা হয়নি আমাদের। আমি অনেকটা জানি তাকে, সেও কিছুটা জানে আমাকে। সেটা এক অম্ল-মধুর যোগাযোগ। বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় কাছাকাছি এলেও কথা হয়নি কখনো। আমি চিনলেও আমাকে সে চিনতো না। একদিন তার হোস্টেলে যাই। তার একটি এওয়ার্ডের ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট পৌঁছে দেয়ার স্বেচ্ছায় নেয়া দায়িত্ব পালন করতে। দায়িত্ব পালনের আড়ালের নিজেকে উপস্থাপনই এখানে মূখ্য। দেখা হয়েছিলো কথাও হয়েছিলো সেদিন। কিন্তু সে বলেছিলো বেশি, আমি শুধু হু-হাঁ বলে উত্তর দিয়েই ক্ষান্ত। তারপর চট্টগ্রাম গেলেই তার সাথে দেখা করার চেষ্টা করতাম। দেখা হয়েছিলো বেশ কয়েকবার। দ্বিতীয়বার দেখা করতে এলে ‘টিটবিটে’ বসেই কিছু সময় কাটিয়েছি।
“আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেলো (মনে মনে), কত সুর কত গান মনে পড়ে গেলো। বল, ভালো আছো তো, বল, ভালো আছো তো?” টিটবিটের দিকে তাকিয়ে পুরোনো দিনে ফিরে গেলাম। এক দশকে কত পরিবর্তন। শুধু স্থান বা কালের নয়, আমাদের জীবনেরও অনেক বাঁক নিয়েছে এ সময়ে। আমার নিজস্ব বলয়ে আমি ব্যস্ত। সে এখন স্বামী, সন্তান এবং সংসার নিয়ে দূর প্রবাসে। পিএইচডি করছে অস্ট্রেলিয়ায়। হয়তো আমাকে তার সেভাবে মনে করার কোনো অবসর নেই। আর মনে করার মতো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাও নেই। আমারও মনে করার তেমন সুযোগ কই। মাঝে মাঝে ফেইসবুকে তার স্টেটাসগুলো দেখি। তার “যাযাবর নামা” পড়ি। যাযাবর ছদ্মনামে লেখে সে। আমি লাইক দিই। কিন্তু এতো ভক্ত-অনুরক্তের মাঝে আলাদাভাবে আমার ‘লাইক’ হয়তো তার নজরেই আসে না। এটা দুঃখ নয়, সামান্য আবেগ। চেনা মানুষের জন্য সুপ্ত অনুরাগ। এর মানে এ নয় যে, তাকে এখনো আগের মতো অনুভব করি। আমার জীবনেরও পট পরিবর্তন হয়েছে। জীবনসঙ্গিনী এসেছে, নতুন অতিথি আসবে। ভাবনাজুড়ে এখন তারাই বেশি। তবু অতীতকে আমরা কেউ সহজে ভুলে থাকতে পারি না। তাই আজ পুরনো স্থানে নতুন করে তাকে মনে পড়ল। তার সাথে আমার কীসের সম্পর্ক ছিলো? তা আজো আমার কাছে স্পষ্ট নয়। না বন্ধুত্ব, না প্রেম। তাহলে কেন আজো তাকে মনে রেখেছি? উত্তর একটাই হতে পারে-তার ব্যাক্তিত্বের প্রতি আমার প্রচ- দুর্বলতা ছিলো। যেহেতু সে ছিলো তুখোড় মেধাবী এবং উদীয়মান কলম সৈনিক। পরিবার বা সৌন্দর্য তেমন বিবেচ্য বিষয় ছিলো না। তবে মাঝে মধ্যে আবেগতাড়িত মনে কল্পনার জাল বুনিনি, তা নয়। তবে এটা কখনো প্রকাশ করিনি। আমাদের যোগাযোগটা ই-মেইলেই বেশি হতো, দুই-চারটা চিঠিও লিখেছিলাম। তাতে প্রেম-ভালোবাসার কোনো শব্দের স্থান ছিলো না। হাতেগোনা যে কয়বার সাক্ষাত হয়েছিলো, সেখানেও লেখাপড়া বা লেখালেখি নিয়েই যতসব আলোচনা হতো।
বন্ধুর ডাকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম। নাঈমা ভাবীর বেরুতে একটু দেরী হবে। আমাদেরকে বাসায় চলে যেতে বলা হলো। কী আর করা- অপেক্ষার পালা এখানে শেষ। কাতালগঞ্জ থেকে জাতিসংঘ পার্কের পাশ দিয়ে হাাঁটা শুরু করলাম। জাতিসংঘ পার্ক জরাজীর্ন পরিবেশ। পার্কের মাঝের পুকুরের পানি বিবর্ণ। সিটি কর্পোরেশনের অযতœ-অবহেলায় পার্কটি হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসে। এর আগে এ পথ দিয়ে কখনো আসিনি। তাই নাম শুনলেও দেখার সুযোগ হয়নি। আজও এই ভর দুপুরে দেখার মানসিকতা নেই। তাছাড়া আমাকে আবার ফিরতে হবে ঢাকায়। বিকাল ৩টায় মহানগর গোধূলী ট্রেন। বন্ধু নূরুল আজিম। আপন ভাইয়ের মতোই আমরা। এক যুগের অধিককালের সম্পর্ক। তার ফ্যামিলির সবাই বলে- আমি তাদেরই ছেলে। ছোট বেলায় আমাকে নাকি দত্তক দিয়েছিলো। বড় হয়ে আবার ফিরে এসেছি। এতই নিকটতর সম্পর্ক। তার বাড়ি কক্সবাজার। (চলবে…)

No comments:

Post a Comment