মানবাধিকার মানবজাতির অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের মধ্যে অন্যতম। মানবাধিকার মানুষের স্বভাবগত। অর্থাৎ মানুষের যে স্বভাব তার মধ্যেই মানবাধিকারের দাবিটি রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুল্লু মাউলুদিন আলাল ফিতরা’। এর অর্থ, প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি স্বভাবের ওপর। সে স্বভাবের মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতা। হজরত উমর রা:-এর একটি বিখ্যাত বক্তব্য আছে : ‘আল্লাহ তো তোমাদের সবাইকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছিলেন, কে তোমাদের গোলাম করল?’ এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য।
আমরা মানবাধিকারের ইতিহাস পর্যালোচনায় গেলে দেখব মদিনা সনদ বা মদিনার রাষ্ট্র গঠনের সময় ইহুদিদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে চুক্তি করেছিলেন, যাকে বলা হচ্ছে : ‘মিসক আল মদিনা’ বা ‘মদিনা চুক্তি’- তার বিভিন্ন দিক রয়েছে। এটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। এর আগে কোনো লিখিত সংবিধান কোনো রাষ্ট্রের ছিল কি না, তা ইতিহাস থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। এ সংবিধানে বিভিন্ন দিকের কথা বলা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে- রাষ্ট্র কেমন হবে, এর শাসক কে হবেন। কিন্তু একই সাথে এ সনদে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কী অধিকার হবে, তা-ও বলে দেয়া হয়েছিল। কাজেই এটি শুধু একটি সাংবিধানিক দলিলই নয়, এটি একটি মানবাধিকার দলিলও। বিশ্বের ইতিহাসে মানবাধিকারের দলিলের মধ্যে মদিনার সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। যদিও আমি আগেই বলেছি, মানুষের স্বভাবের মধ্যে এটি আছে। কিন্তু ডকুমেন্ট হিসেবে যদি আমরা দেখতে চাই তাহলে মদিনা সনদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝা যায়।
মানবাধিকার নিয়ে এরপর অনেক কাজ হয়েছে। সেখানে ফ্রিডম, লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসির কথা বলা হয়েছে। এটি ইউরোপসহ বিশ্বের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাতেও মানুষের অধিকারের কথা আলোচিত হয়েছে। এভাবে এর একটি ঐতিহাসিক বিকাশ আমরা মানবাধিকারের ইতিহাসে দেখতে পাই। কিন্তু এর পরও কোনো দলিলে সব মানবাধিকার আনার কাজটি আগে হয়নি। এ কাজটি হয় ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদে ‘জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার’ ঘোষণার মাধ্যমে।
মানব ইতিহাসে বিভিন্ন ঘোষণায়, দলিলে বা বিভিন্ন লেখকের লেখায় এর আগে যেগুলোকে মানবাধিকার বলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা একত্র করে জাতিসঙ্ঘের সব রাষ্ট্র একমত হয়ে এ দলিল প্রণয়ন করে। এ দিক থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ। এতে মানবজাতির সব রাষ্ট্রের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছিল- এটিকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু যেহেতু এ প্রশ্নটি ছিল এবং আছে যে, ইসলাম মানবাধিকার দিয়েছে কি না, দিলে কতটুকু দিয়েছে? মানবাধিকারসংক্রান্ত ইসলামের যেহেতু একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং যেহেতু ইসলাম মূলত একটি নৈতিক শক্তি, সে জন্য তার একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সে কারণে যখন ওআইসি গঠিত হয় তখন এর নেতারা উপলব্ধি করলেন, তাদের একটি মানবাধিকার দলিল খাড়া করা দরকার। সে কাজটি শুরু হয় আশির দশকের প্রথম দিকে। ১০ বছর ধরে কাজ হয়। তার জন্য সব ইসলামি চিন্তাবিদ, আইনজ্ঞ, ফিকাহবিদের একসাথে যুক্ত করে ওআইসির ফিকাহ অ্যাকাডেমি এ দলিল তৈরি করে। নানা পদ্ধতি, ঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালে কায়রোতে এ ডকুমেন্টটি পাস করা হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এখানে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ধারা-১
a. All human beings from one family whose members are united by submission to God and descent from Adam. All men are equal in terms of basic human dignity and basic obligations and responsibilities, without any discrimination on the grounds of race, color, language, sex, religious belief, political affiliation, social status or other considerations. True faith is the guarantee for enhancing
such dignity along the path to human perfection.
b. All human beings are God's subjects, and the most loved by Him are those who are most useful to the rest of His subjects, and no one has superiority over another except on the basis of piety and good deeds.
অনুবাদ : ধারা-১
ক. আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক মতবাদ, সামাজিক অবস্থান বা অন্য যেকোনো বিবেচনা নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সব মানুষ সমান। খাঁটি ঈমান ব্যক্তির মধ্যে মানবিক পূর্ণতা এনে দিয়ে এ মর্যাদা বাড়ানোর গ্যারান্টি দেয়।
খ. প্রত্যেক মানুষ আল্লাহর অধীন। সেসব ব্যক্তিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যারা তার সমগ্র সৃষ্টিজগতের কল্যাণে নিয়োজিত এবং শুধু খোদাভীতি (তাকওয়া) ও সৎকর্মের ভিত্তিতেই একজন মানুষ অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে।
এ ধারাতে মানবজাতি বা সব মানুষের যে মৌলিক সমতা তা ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ লিঙ্গ, জাতি, রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে ভেদাভেদ না করে মতবাদনির্বিশেষে সবাই যে আল্লাহ তায়ালার অধীন বান্দা এবং তারা মানুষ হিসেবে সমানÑ এ কথাটিই তাতে বলা হয়েছে।
এ সনদের ২ নম্বর ধারায় মানুষের জীবন রক্ষার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে :
ক. জীবন হলো খোদাপ্রদত্ত একটি উপহার এবং প্রত্যেক ব্যক্তিরই জীবনধারণের সুনিশ্চিত অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য এ অধিকারকে যেকোনো ধরনের অবমাননা থেকে রক্ষা করা। শরিয়াহ নির্দেশিত কোনো কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা হারাম বা নিষিদ্ধ।
খ. এমন কোনো কাজ করা বা উপায় অবলম্বন করা নিষিদ্ধ, যা মানবজাতির ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গ. স্রষ্টাকর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে (Term of time willed by Allah) কারো জীবন রক্ষা করা শরিয়াহ নির্দেশিত একটি কর্তব্য।
ঘ. শারীরিক ক্ষতি বা নির্যাতন থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার জন্যই সুরক্ষিত। একে নিশ্চয়তা দান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং শরিয়াহ নির্দেশিত কোনো কারণ ছাড়া এ অধিকার লঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ।
তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, মানুষের বিরোধ মীমাংসার জন্য কোনো রকম সশস্ত্র সঙ্ঘাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। এ গোটা ডকুমেন্টই ইসলামি নীতির আলোকে প্রণীত হয়েছে। এ ধারায়ও বলা হয়েছে, যুদ্ধ যদি শুরু হয়েই যায় তাহলে যারা যুদ্ধরত নয় তাদের হত্যা করা যাবে না। বৃদ্ধ, মহিলা, শিশুদের হত্যা করা যাবে না। আহত ও অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। যুদ্ধবন্দীদের খাওয়ানো ও আশ্রয় দেয়াসহ সব কিছু করতে হবে। মৃতদেহ অবমাননা করা যাবে না। যুদ্ধবন্দী বিনিময় করতে হবে। বন্দী অবস্থায় তাদের দেখতে দিতে হবে। ফসল নষ্ট করা যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, সাধারণ জনগণের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা যাবে না।
মেয়েদের অধিকার সম্পর্কে এ সনদের ৫ নম্বর ধারায় আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরিবার হলো সমাজের ফাউন্ডেশন। পরিবারকে বিয়ের মাধ্যমে গঠন করা হবে। এ ধারার মাধ্যমে লেসবিয়ানিজম, সমকামিতা, ছেলে-ছেলে, মেয়ে-মেয়ে বিয়ে অস্বীকার করা হয়েছে। এ ধারায় আরো বলা হয়েছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে বিয়ের পথে যত প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করা এবং তাকে সহজ করে দেয়া। এগুলোতে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। পরিবারকে তার সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর অধিকার সম্পর্কে ৬ নম্বর ধারায় সুন্দর করে বলা হয়েছে। ধারাটিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : ক. মর্যাদা এবং তা ভোগ করার অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান। নারীর রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বা পরিচয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং তার নিজের নাম ও বংশপরিচয় বজায় রাখার অধিকার।
খ. পরিবারের ভরণপোষণ ও সার্বিক কল্যাণের দায়দায়িত্ব স্বামীর ওপর বর্তাবে। অন্য ধারা ৭-এ বাবা-মা এবং শিশুদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেক মানুষের শিক্ষার অধিকারের কথা ধারা ৯-এ বলা হয়েছে।
অনুবাদ : ধারা ৯
ক. জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক এবং শিক্ষার সুব্যবস্থা করা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্র শিক্ষা অর্জনের সব পদ্ধতিকে সহজলভ্য করবে এবং সমাজের স্বার্থে শিক্ষাকে বহুমুখী করার প্রতিশ্রুতি দেবে যেন তা মানবজাতির কল্যাণে মানুষকে ইসলাম ধর্ম ও সমগ্র বিশ্বের প্রকৃত অবস্থার সাথে পরিচিত করে তোলে।
খ. বিভিন্ন শিক্ষা ও পথনির্দেশনামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন পরিবার, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রচারমাধ্যম প্রভৃতি থেকে ধর্মীয় ও দুনিয়াবি শিক্ষা লাভের অধিকার প্রত্যেক মানুষের রয়েছে। তার এ শিক্ষা লাভের অধিকার এমন যে, তা ভারসাম্য ও সমগ্রতা পায় তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস (ঈমান) দৃঢ়করণে, তার অধিকার ও কর্তব্য বা বাধ্যবাধকতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং এর সুরক্ষার ব্যাপারে এ শিক্ষা তার ভেতরে এনে দেয় উৎকর্ষ।
এ সনদের ১১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন সত্তা হিসেবে জন্ম নেয়। কাউকে দাস করা যাবে না, গোলাম করা যাবে না, সব ধরনের উপনিবেশবাদ নিষিদ্ধ। তেমনিভাবে অন্যান্য ধারায় মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সবারই কাজ করার অধিকার থাকার কথা বলা হয়েছে। সুদ নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। আইনসম্মতভাবে যে সম্পত্তির মালিকানা থাকবে তা ভোগের অধিকারের কথা ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে। ধারা ১৭-এ পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাসের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ১৮ নম্বর ধারায় নিরাপত্তার সাথে বাস করার অধিকারের কথা আছে। ধারা ২০-এ অন্যায়ভাবে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কাউকে জিম্মি বা পণবন্দী না করার ব্যাপারে ২১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনিভাবে এখানে বলা হয়েছে সবারই তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে, যদি তা শরিয়তের নীতিমালার বিরোধী না হয়।
ধারা ২২-এ বলা হয়েছে, দায়িত্ব বা ক্ষমতা আমানত মাত্র। ধারা ২৪-এ বলা হয়েছে, এ সনদের আলোকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, এগুলো ইসলামি শরিয়তের আওতায় হবে। যদি কোনো কিছুর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় তাহলে সেটি ইসলামি শরিয়াহ থেকে নিতে হবে। এ কথা সর্বশেষ ধারা ২৫-এ বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, The Islamic Shariah is the only source of reference for the explanation or clarification of any of the articles of this Declaration.
মুসলিম বিশ্বের জন্য এ সনদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখের সাথে বলতে হয়, এ দলিলটি যতটা প্রচার হওয়া দরকার ছিল এটি সেভাবে হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতে এটি ব্যাপকভাবে ছড়াবে। ইসলামের আলোকে সর্বসম্মত মানবাধিকার ঘোষণার এ অত্যন্ত মূল্যবান দলিলের মাধ্যমে আমাদের জাতি-সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : শাহ্ আব্দুল হান্নান, সাবেক সচিব
No comments:
Post a Comment