মানবসভ্যতার মতো ফেসবুককেও যদি কয়েকটা যুগে বিভক্ত করা যায়, তাহলে কোন যুগের অবদান কেমন হবে,
প্রাচীন যুগ (২০০৪-০৮)
অনেকের মতে, এই যুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়ে থাকে। কারণ, এ যুগে মানুষ ফেসবুক সম্পর্কে খুব কমই জানত। এ যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো...
১. এ যুগে বাংলাদেশি কারও ফেসবুক আইডি ছিল কি না; এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মধ্যে সন্দেহ আছে।
২. এ যুগে ফেসবুকে একটা আইডি খুলতে পারাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, অনেকেই আইডি খুলতে গিয়ে প্যাঁচানো অপশনের গর্ভে হারিয়ে যায়।
৩. এ যুগে যাদের ফেসবুক আইডি ছিল, তারা অনেকেই স্ট্যাটাস এবং ছবিতে লাইকহীনতায় ভুগত।
৪. সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক শুধু এই যুগেই সামাজিক ছিল; পরে অসামাজিক হয়ে যায়!
৫. এ যুগে ফেসবুকের কল্যাণে বহু প্রেমকাহিনির সূচনা হয়। অনেকেই ভার্চ্যুয়ালি ‘প্রেমপত্র’ পাঠাতে শুরু করে মেসেজ অপশন চালু হওয়ার পর। যদিও অধিকাংশ প্রেমপত্র হয়তো এখনো ‘আদার্স’ বক্সে পড়ে আছে নিদারুণ অবহেলায়।
৬. ‘ফেক আইডি’ বিষয়টার প্রচলন এই যুগের শেষ দিকে। এ সময় একদল ছেলে মেয়েদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে আইডি খুলতে থাকে। এর ফাঁদে পড়ে আবার আরেক দল ছেলে পকেটের টাকা–পয়সাও বিসর্জন দিয়েছে এক বা একাধিকবার। পরবর্তী সময়ে সেসব ভুক্তভোগী আবার নিজেরাই ফেক আইডি খোলার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়।
মধ্যযুগ (২০০৯-১৩)
এ যুগকে ‘সেলিব্রিটি যুগ’ বলা হয়। কারণ, বর্তমান ফেসবুক সেলিব্রিটিদের আবির্ভাব হয় এ যুগেই। এ যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো অনেকটা এ রকম...
১. এ যুগে ফেসবুকে যারা বিভিন্ন ইস্যুতে কারণে-অকারণে নিয়মিত স্ট্যাটাস দিত, তারা আজ তথাকথিত ‘ফেসবুক সেলিব্রিটি’ নামে পরিচিত। এরাই প্রথম প্রমাণ করে দেখিয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমের সাহায্য ছাড়াও কীভাবে সেলিব্রিটি হওয়া যায়।
২. এ সময়ে মার্ক জাকারবার্গ এবং তাঁর স্ত্রীর ছবি ফেসবুকে প্রথম প্রকাশিত হয়। আর তারপরই বাংলা ভাষাভাষীদের বিচিত্র কমেন্ট সেই ছবির নিচে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে দেখা যায়। মার্ক জাকারবার্গ সেসব কমেন্টের অর্থ বুঝেছেন কি না; তা একটা অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই থেকে গেছে।
৫. ‘অ্যাড মি, আই অ্যাম বলক’ এবং ‘লাইক ব্যাক’ নামক দুটি বিখ্যাত কমেন্ট এই যুগের শেষের দিকে এসে জনপ্রিয়তা পায়। যত বেশি ফ্রেন্ড অ্যাড করা যায়, ততই ভালো—এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় শক্তভাবে।
৬. পাড়ার জরিনা আক্তার ‘অ্যাঞ্জেল জেরিন’ নামে এবং পাড়ার জয়নাল ‘হার্ট হ্যাকার জন’ নামে ফেসবুকে অভিষেক করে এই যুগেই।
৭. এ যুগে আকাশের চাঁদে পৃথিবীর কারও মুখ দেখতে পাওয়ার মতো ‘যুগান্তকারী খবরের’ প্রচারযন্ত্রও হয়ে ওঠে ফেসবুক।
আধুনিক যুগ (২০১৪-বর্তমান)
এই যুগ ‘টাকলা যুগ’ মতান্তরে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের’ যুগ নামে পরিচিত। এ সময় বাংলা ভাষা ও পরীক্ষা-ব্যবস্থায় ফেসবুক বহুমাত্রিক ভূমিকা রাখছে। এই যুগের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো...
১. এই যুগের শুরুর দিক থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও পাবলিক পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের কাছে ফেসবুক হয়ে ওঠে পরম আরাধ্য। প্রশ্নপত্র ফাঁসের যন্ত্র হয়ে ওঠে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় পাবলিক পরীক্ষার ফলেও। ঘরে ঘরে জিপিএ-ফাইভের বাম্পার ফলন।
২. টাকলামির ব্যাপক প্রচলন এই যুগে শুরু হয়। এটা এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, সুস্থ মানুষেরাও টাকলামির প্র্যাকটিস করতে থাকে এবং টাকলা ভাষায় স্ট্যাটাস দিতে থাকে। ফ্রেন্ড থেকে ফ্রান্স, লোল থেকে লুল, জিএফ-বিএফ থেকে গফ-বফ; এ রকম অসংখ্য ভাষাগত পরিবর্তন এই যুগেই ঘটতে দেখা যায়।
৩. এই যুগের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মানুষ মরুক আর বাঁচুক, আগে সেলফি তোলা চাই’। এ কারণেই মানুষকে বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে সেলফি তুলতে দেখা যায়। বিশেষ করে মুখ বাঁকিয়ে হাঁসের মতো করে সেলফি তোলা বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়।
৪. ফেসবুকের কল্যাণে ‘হিট খেয়ে’ হিরো আলমের মতো ‘সেলিব্রিটি’র আবির্ভাবও হয় এই যুগে। আর এই হিরো আলমকে নিয়ে জাতি হয়ে যায় দ্বিধাবিভক্ত। এক দল তার পক্ষে আরেক দল বিপক্ষে। এই রীতি অবশ্য যেকোনো ইস্যুতেই মেনে চলেছে বঙ্গবাসী।
৫. এ যুগে এসে মানুষ ট্রাম্পের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিকেও মেসেজ দেওয়ার মতো পন্থা আবিষ্কার করে। নির্বাচনের আগে ট্রাম্প সবাইকে রিপ্লাই দিতেন, কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরপরই তিনি রাজনীতিবিদদের রূপ ধারণ করে ফেলেন। অর্থাৎ স্বার্থ ফুরানোর পর আর কাউকে রিপ্লাই দেননি।
তবে ডোনাল্ট ট্রাম্প তার FBI দিয়েও বাংলাদেশের চিকন পিনের চার্জারের রহস্য আজ ও বের করতে পারেনি।
No comments:
Post a Comment