অধ্যাপক ডাঃ এম আলমগীর চৌধুরী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইএনটি আনোয়ার খান মর্ডাণ মেডিক্যাল কলেজ, ধানমন্ডি, ঢাকা
প্রতি
বত্সর ১৬ এপ্রিল বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালন করা হয়। বিগত ছয় বত্সর ধরে ২০০৮ সাল
থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস উদযাপন করা হয়। অ্যামেরিকান ন্যাশনাল
ইনস্টিটিউট অব ডেফনেস এন্ড কমিউনিকেশনের সূত্র মতে ৭.৫ মিলিয়ন সব বয়সের
জনগণ কোন না কোন কণ্ঠস্বর জনিত সমস্যায় ভুগছে। আমরা কণ্ঠস্বর সম্পর্কে
সচেতন নই এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হই। পারস্পারিক
যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো কণ্ঠ বা কথা বলা। বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের
উদ্দেশ্য হচ্ছে কণ্ঠ ও কণ্ঠনালীর সমস্যা এবং সেই সাথে কিভাবে কণ্ঠকে সুস্থ
রাখা যায় ও তার প্রতিকার সম্পর্কে জনগণকে জানানো। বিশ্ব কণ্ঠ দিবস এবছরের
প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে 'Connect with your voice'।
কণ্ঠনালীর সমস্যার কারণ সমূহ
কণ্ঠনালীর
সমস্যার জন্য উপসর্গগুলো হলো গলা ব্যথা, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন, কাশি, কিছু
গিলতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্ঠ ইত্যাদি। যদি ঘন ঘন কণ্ঠস্বও পরিবর্তন হয় বা
দীর্ঘ দিন বা দুই সপ্তাহে ভাল না হয়, তবে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ দেখাতে
হবে। বিভিন্ন কারণে কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হতে পারে।
কণ্ঠনালীর প্রদাহ
কণ্ঠনালীর
প্রদাহ দু'ধরনের যেমন- তীব্র ও দীর্ঘ মেয়াদী ল্যারিনজাইটিস। কণ্ঠস্বর
পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো কণ্ঠনালীর ভাইরাস জনিত তীব্র প্রদাহ।
শ্বাসনালীর ভাইরাস প্রদাহে কণ্ঠনালী ফুলে যায় যাতে কণ্ঠনালীর কম্পনের
সমস্যা সৃষ্টি করে, ফলে স্বর পরিবর্তন হয়। আবহাওয়া পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণের
কারণেও কণ্ঠনালীর প্রদাহ বা ল্যারিনজাইটিস হতে পারে। প্রচুর পরিমাণ পানি
পান করলে এবং কণ্ঠনালীকে বিশ্রাম দিলে এই রোগটি ভাল হয়ে যায়। তীব্র প্রদাহ
অবস্থায় যদি কেউ জোরে কথা বলে তা কণ্ঠনালীর উপর চাপ সৃষ্টি করে। যেহেতু
তীব্র কণ্ঠনালীর প্রদাহ ভাইরাস জনিত সেহেতু এরোগে এন্টিবায়োটিক লাগে না।
যদি ব্যাকটেরিয়া জনিত কণ্ঠনালীর ইনফেকশন হয় এবং এর সাথে শ্বাস কষ্ট হয় তখন
বিশেষ চিকিত্সার প্রয়োজন হয় এবং পূর্ণমাত্রায় সঠিক এন্টিবায়োটিক লাগে।
তীব্র কণ্ঠনালীর ভাইরাস জনিত প্রদাহ ঠিকমত চিকিত্সা না করা হলে, দীর্ঘ
মেয়াদী ল্যারিনজাইটিস হতে পারে। পাকস্থলীর এসিড রিফ্লাক্সের জন্য দীর্ঘ
মেয়াদী কণ্ঠনালীর প্রদাহ হতে পারে। ধূমপান, অতিরিক্ত গরম চা বা পানীয় পান
করলে, হাঁপানীর জন্য ইনহেলার ব্যবহার বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম
তাদের দীর্ঘ মেয়াদী ল্যারিনজাইটিস হতে পারে।
কণ্ঠস্বরের অতি ব্যবহার
আমরা
যখন কথা বলি, কণ্ঠনালীর সাথে আশে পাশে অবস্থিত মাংসপেশীরও সাহায্য লাগে।
কণ্ঠনালীকে সঠিক ও নিয়মের বাইরে ব্যবহার করা, অতি উচ্চস্বরে অতিরিক্ত কথা
বলা, দীর্ঘ মেয়াদী বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বললে কণ্ঠনালীর প্রদাহ দেখা দিতে
পারে। যা ভারী জিনিসকে ঠিকভাবে না উঠানোর জন্য পিঠে ব্যথা হওয়ার সমতুল্য।
গলা ও শব্দযন্ত্রের মাংসপেশীর সংকোচন এবং কথা বলার সময় ঠিক ভাবে শ্বাস না
নিলে শ্বাসযন্ত্রের অবসাদ হয়, কথা বলতে কষ্ট হয় এবং ফলশ্রুতিতে কণ্ঠস্বর
পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে এবং ভোকাল কর্ডে পলিপ বা নডিউল এমনকি রক্ত ক্ষরণও
হতে পারে।
ভোকাল কর্ড অপব্যবহারের কারণ সমূহ
অধিক জন
সমাবেশে, কোলাহল পূর্ণ পরিবেশে জোরে কথা বলা। অতিরিক্ত এবং দীর্ঘ সময়
ফোনে কথা বলা। ঘাড় ও কানের মাঝে ফোন চেপে ধরে কথা বলায় ঘাড় ও
শব্দযন্ত্রের মাংসপেশীতে টান লাগে। উচ্চস্বরে বা চিত্কার করে কথা
বলা।জনসমাবেশে বা বড় লেকচার গ্যালারীতে মাইক ছাড়াই জোরে কথা বলা।
কম ক্ষতিকারক কণ্ঠনালীর
রোগ সমূহ
বার
বার অথবা দীর্ঘ মেয়াদী কণ্ঠনালীর অপব্যবহারে যে ক্ষতি হয় পরবর্তিতে তা
কণ্ঠনালীর কম্পনের মাত্রার উপর প্রভাব ফেলে এবং কণ্ঠনালীতে পলিপ, নডিউল বা
সিস্ট হতে পারে। নডিউল সাধারণত কণ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে বেশী হয়। রাজনীতিবীদ,
শিক্ষক, আইনজীবি, অধিক সন্তানের জননী, মসজিদের ইমাম, হকারদের মধ্যে এসব
রোগ হতে পারে। চিকিত্সা হলো অপারেশন যেমন মাইক্রোলেরিংগোসকপি এবং
ভয়েস থেরাপী।
ভোকাল কর্ড প্যারালাইসিস
বা দূর্বলতা
ভোকাল
কর্ড বা ল্যারিংসের নার্ভের দুর্বলতা বা কোন সমস্যার জন্য কণ্ঠনালীর
পরিবর্তন হতে পারে। ভাইরাস জনিত প্রদাহের জন্য নার্ভের দুর্বলতা হয়।
সাধারণত এক দিকের নার্ভ-ই প্যারালাইসিস হয়, দু'দিকের নার্ভ একই সাথে
আক্রান্ত হওয়া খুবই বিরল। এক দিকের নার্ভ প্যারালাইসিসের কারণ হচ্ছে ভাইরাল
ইনফেকশন, টিউমার, ক্যান্সার ও থাইরয়েড অপারেশন। কণ্ঠনালীর প্যারালাইসিসের
জন্য ফেঁসফেঁসে আওয়াজ হয় এবং এটি নিঃশ্বাসের সাথে জড়িত। কয়েক মাসের মধ্যে
একদিকের প্যারালাইসিস ভাল হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ভোকাল কর্ড
প্যারালাইসিস ভালো হয় না, তখন চিকিত্সা প্রয়োজন হয়।
কণ্ঠনালীর ক্যান্সার
আমাদের দেশে গলার ক্যান্সার বা কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের প্রকোপ অনেক বেশি। গলার স্বর পরিবর্তনের পনের দিনের মধ্যে ভালো না হলে,
চিকিত্সকের
পরামর্শ নেয়া দরকার। রোগীর ইতিহাস, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গলার ক্যান্সার
বা কণ্ঠনালীর ক্যান্সারকে মোটেও অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ কণ্ঠনালীর
ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিত্সা করলে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে
যায় এবং এ রোগের সব ধরণের চিকিত্সা যেমন- সার্জারী, কেমোথেরাপী ও
রেডিওথেরাপী আমাদের দেশে বিদ্যমান।
কিভাবে কণ্ঠকে সুস্থ এবং
সুন্দর রাখা যায়
পানি
ভোকাল কর্ডকে আদ্র রাখে এবং আদ্র ভোকাল কর্ড শুষ্ক ভোকাল কর্ড থেকে
বেশি ব্যবহার করা যায়। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন, কমপক্ষে
দুই
থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে। খেলা শুরুর পূর্বে যেমন প্রস্তুতি
দরকার তেমন বক্তৃতার পূর্বে ভোকাল কর্ডের একইভাবে হালকা ব্যায়াম করা উচিত।
প্রস্তুতি ছাড়া কোন কাজে নামা উচিত নয়। প্র্যাক্টিস করলে ভোকাল কর্ডের
কণ্ঠের মান ও উপস্থাপনা সুন্দর হয়। কথা বলা বা গান গাওয়ার
মাঝখানে
দীর্গ শ্বাস- প্রশ্বাস নিলে কথা বলা, গান গাওয়াকে সুন্দর করে এবং ভোকাল
কর্ডের অবসাদ হয়না। বক্তব্য বা উপস্থপনা বা বড় সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার সময়
মাইক্রোফোন ব্যবহার করা উত্তম। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কণ্ঠনালীকে
বিশ্রাম দেয়া উচিত। যা কণ্ঠনালীর অবসাদ দূর করে এবং শক্তি ফিরিয়ে দেয়।
নিজের কণ্ঠকে শুনুন এবং যদি কোন রকমের উপসর্গ থাকে বা পরিবর্তন লক্ষ্য
করেন তাহলে যথাযথ যত্ন নিন। যদি দু'সপ্তাহের বেশী স্বর পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়
হয়, তাহলে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এমন কিছু করবেন না যা
কণ্ঠনালীর ক্ষতি হয়।
ধূমপান, এলকোহল পান, অতিরিক্ত গরম পানীয় পান
করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
ইহা ছাড়াও ধূমপান কণ্ঠনালীর প্রদাহ করে। জোরে জোরে বা পরিবর্তিত স্বরে
কথা বলা উচিত নয়। জোরে কথা বললে বা কণ্ঠনালীর অপব্যবহার করলে কণ্ঠনালীতে
সুক্ষ আঘাত হতে পারে। দূর হতে কাউকে ডাকতে হলে হাত তালি বা শীষ বা হাত নেড়ে
অথবা লাইটের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। বড় খেলা উপভোগ করার সময়
পছন্দের দলকে সাপোর্ট করার জন্য জোরে চিত্কার না করে পতাকা উড়ান বা
ব্যানার লিখেন।
তাই মাথা উচুঁ করে ঘুমাবেন, টাইট কাপড় পরে ঘুমানো
যাবে না, হালকা ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করে ঘুমাবেন। খাবারের সাথে সাথে
ঘুমানো বা ক্যাফেইন যুক্ত খাবার গ্রহণ করা বাদ দিতে হবে। গাড়ীতে ভ্রমণ বা
ট্রেনে যাতায়তের সময় কণ্ঠনালীকে বিশ্রাম দিন। দৈনন্দিন কর্মকান্ডে ভোকাল
কর্ডে চাপ পরে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে
সাবধানতা অবলম্বন করুন। চিন্তা করুন ফোন কলটি আপনার প্রয়োজনীয় কিনা।