Pages

Thursday, December 19, 2019

তাসাউফ নিয়ে লেখা...

চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনে ও ব্যক্তি উন্নয়নে এবং আদর্শবান সুনাগরিক তৈরিতে উসূলে সাবআ'

বর্তমান ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বিশ্বব্যবস্থা নানা পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ শান্তির খোঁজে উন্মুখ। ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সর্বত্র নানাধরণের বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। মানবসভ্যতা বহুবিধ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় উতরিয়ে মুক্তির সত্য-সুন্দর পথের অন্বেষায় চলছে অব্যাহত প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টাগুলোর অন্যতম প্রধান প্রচেষ্টা হলো ব্যাক্তির চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, ব্যাক্তিত্বের উন্নয়ন ও আদর্শবান সুনাগরিক তৈরির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের অরাজক পরিস্থিতিসমূহকে পশমিত করে মানবসমাজে সুশৃঙ্খল ও সুন্দর পরিবেশ আনয়ন। কারণ ব্যাক্তি মানুষের সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থার সামগ্রিক অনুষঙ্গ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। আর চরিত্র গঠন, ব্যাক্তিত্ব উন্নয়ন ও আদর্শ নাগরিক তৈরির উপাদানসমূহ আত্না, অন্তর, মন, মনন ও মানসিকতা এবং আচরণের বহিঃপ্রকাশের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই তাসাউফ তথা আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্নিকতার পরিক্রমায় এসব অনুপম গুণাবলি স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। আলোচ্য নিবন্ধে চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, ব্যক্তি উন্নয়ন ও আদর্শবান সুনাগরিক তৈরিতে বাংলাদেশে উদ্ভূত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) প্রবর্তিত তাসাউফ পন্থা উসূলে সাবআ' তথা সপ্ত-কর্মপদ্ধতির ভূমিকা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস রইলো।

চরিত্র হলো মানুষের অন্তর্গত দিক এবং আচরণই তার প্রতিচ্ছবি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- "যার চরিত্র যেমন তার জীবনসঙ্গীও হবে তেমন।” (সূরা আল নূর- ২৬) সুন্দর চরিত্রের চেয়ে মহামূল্যবান সম্পদ অন্যকিছুই হতে পারে না। সবার উচিৎ সুন্দর চরিত্র গঠনে আত্মনিয়োগ করা। তাহলেই পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত মানুষ হওয়া সম্ভব। আর ভালো মানুষ হলেই সবার ভালোবাসারপাত্রে পরিণত হওয়া যায়। মহানবী স. বলেছেন- "মানুষের মধ্যে সেই ব্যাক্তি উত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর।"

ব্যক্তিত্ব হলো মানুষের কতগুলো আচরণে বহিঃপ্রকাশ। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যক্তিত্ব তার স্বকীয় বংশগতি ও পরিবেশের যৌথ ফলাফল। "ব্যক্তিত্ব হলো যখন প্রত্যেকে দেখে আমি কী করি। চরিত্র হলো যখন কেউ দেখছে না আমি কী করছি।" ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা: “A brief definition would be that personality is made up of the characteristic patterns of thoughts, feelings and behaviors that make a person unique. In addition to this, personality arises from within the individual and remains fairly consistent throughout life”. চরিত্র সুন্দর হলে ব্যাক্তিত্ব উন্নত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ সচ্চরিত্র ও সুশীল ব্যাক্তিত্ব গঠনের পথ সরলরৈখিক। তাই হযরত আলী (রা.) বলেছেন- "মানুষের চরিত্র সত্য ও সুন্দর হলে তার কথাবার্তাও নম্র ভদ্র হয়।"

‘তাসাউফ’ আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ সুফিবাদ, আধ্যাত্মিকতা, অধ্যাত্মবাদ। মুসলিম দর্শনে ‘তাসাউফ’ সুফিবাদ নামে খ্যাত। তাসাউফ বা সুফিবাদের পারিভাষিক বর্ণনায় শাইখুল ইসলাম জাকারিয়া আল আনসারি (রহ.) বলেন, ‘যে ইসলামের দ্বারা অনন্ত সৌভাগ্য লাভের উদ্দেশ্যে আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের প্রক্রিয়া এবং মানুষের জাহির ও বাতিন গঠন করা সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়, তাকে ইলমে তাসাউফ বলা হয়।’ আল্লামা শামি (রহ.) বলেন, ‘ইলমে তাসাউফ হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সৎগুণগুলোর প্রকারভেদ এবং তা অর্জনের পন্থা ও অসৎ স্বভাবগুলোর শ্রেণিবিভাগ এবং তা থেকে আত্মরক্ষার উপায় অবগত হওয়া যায়।


সুন্দর চরিত্রের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর কিছুই হতে পারে না । আর তাই আমাদের সবার উচিৎ আমাদের এবং আমাদের চারপাশের সবার চরিত্র নিয়ে চিন্তা করা । সবার উচিৎ সুন্দর চরিত্র গঠনে আত্মনিয়োগ করা । তাহলে আমরা সবাই ভালো মানুষ হতে পারবো । আর ভালো মানুষ হলে সবাই আমাদের ভালোবাসবে ।
” যার চরিত্র যেমন তার জীবন সঙ্গী ও হবে তেমন। ”
– সূরা আল নূর – ২৬
”মানুষের মধ্যে সেই ব্যাক্তি উত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। “ – মহানবী (সাঃ)
"মানুষের চরিত্র সত্য ও সুন্দর হলে তার কথাবার্তাও নম্র ভদ্র হয়।" (আলী রা.)

” ব্যক্তিত্ব হ’ল যখন প্রত্যেকে দেখে আমি কি করি। চরিত্র হলো যখন কেউ দেখছে না আমি কি করছি । “

ব্যক্তিত্ব হলো মানুষের কতগুলো আচরণে বহিঃপ্রকাশ। এক একজন মানুষের অভিব্যাক্তি একেক রকম । তাই কখনই একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব আরেকজনের মত হয় না । এটা হয়তো মানুষের ব্যক্তিত্বসম্পন্নের স্বকীয়তা । ব্যক্তিত্বের চেহারা গুরু গম্ভীর, হাস্যজ্বল, কুটিল, দয়াবান, সদা চঞল সবরকমই হতে পারে আর ব্যক্তিত্ব কিন্তু মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একই রকম থাকে না । এটা বিভিন্ন বয়সের সাথে পরিবর্তনশীল ।
ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা: “A brief definition would be that personality is made up of the characteristic patterns of thoughts, feelings and behaviors that make a person unique. In addition to this, personality arises from within the individual and remains fairly consistent throughout life”.
ব্যক্তিত্ব আর মানবিক সর্ম্পক আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানবিক সর্ম্পকের উন্নয়ন ছাড়া ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন অসম্ভব।
যাইহোক, ব্যক্তিত্বের সকল তত্বব্যাখা দেওয়া সম্ভব কি না জানি না। তবে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যক্তিত্ব তার স্বকীয় বংশগতি ও পরিবেশের যৌথ ফলাফল ।

আল্লামা রূমী-- “যদি আলো থাকে তোমার হৃদয়ে তাহলে ঘরে ফেরার পথ তুমি অবশ্যই খুঁজে পাবে।”
“তুমি এখনও জানোনা! হ্যা, এটা তোমার আলোই, তোমার আলোই এই জগতকে আলোকিত করে।”
“যা তোমায় পরিশুদ্ধ করে, তাই সঠিক পথ।”
"তুমি কি তোমার আত্মার খোঁজ করছো? তবে তোমার মনের খাঁচা থেকে অবমুক্ত হও।”

ব্যক্তি ও সমাজজীবনে #তাসাউফের গুরুত্ব
সাবরিনা ইসলাম ঝর্ণা

ইলমুত তাসাউফের সূচনাস্তর হলো ইখলাসের সঙ্গে আমলকে সুন্দর করা এবং এর শেষ স্তর হলো ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করো যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তবে এ বিশ্বাসে উপনীত হও যে তিনি তোমাকে দেখছেন।’ তাসাউফ এমন সব সুন্দর চরিত্রের নাম, যেগুলো সুন্দর সময় ভালো মানুষ থেকে নেক সম্প্রদায়ের মাঝে প্রকাশ পায়।

তাসাউফ বলতে এমন ইলমকে বোঝায়, যার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির অবস্থা, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সম্পর্কে জানা যায় এবং জাহের ও বাতেন তথা বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিকগুলো গঠনের মাধ্যমে চিরস্থায়ী সৌভাগ্য লাভ করা যায় এবং যার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর মারেফত তথা নৈকট্য অর্জন হয়। ইলমে তাসাউফের প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিক ইলম অর্জন করল, কিন্তু ইলমে ফিকহ অর্জন করল না, সে যেন যিন্দিক তথা ধর্মচ্যুত হলো। আর যে ইলমে ফিকহ অর্জন করল, কিন্তু ইলমুত তাসাউফ অর্জন করল না, তবে সে ফাসেক তথা সত্যভ্রষ্ট। আর যে ব্যক্তি উভয় ইলম অর্জন করল, সে-ই মুহাক্কিক তথা গ্রহণযোগ্য আলেম হলো।
বান্দার মধ্যে সুন্দর গুণাবলি সৃষ্টি ও সমাজ থেকে অসদাচরণগুলো দূর করার ক্ষেত্রে তাসাউফ যেরূপ কার্যকর ভূমিকা পালন করে, অন্য কিছু এরূপ ভূমিকা রাখে না। নিশ্চয়ই অনেক ব্যক্তির সমন্বয়ে জনগোষ্ঠী নিয়েই সমাজ তৈরি হয়। সুতরাং সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি যখন নিষ্কলুষ হবে, তখন পুরো সমাজ অপরিহার্যভাবে সুন্দর হবে। মানুষ তার বাহ্যিক ও আত্মিক পবিত্রতার মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হবে। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওই ব্যক্তি সফলকাম হয়েছে, যে তার নফসকে পবিত্র করেছে এবং ওই ব্যক্তি ধ্বংস হয়েছে, যে তার নফসকে অপবিত্র করেছে।’ (সূরা শামস : আয়াত ৯-১০)। আত্মিক এ পবিত্রতা যদি কারও মধ্যে না থাকে, তবে সে হয় চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। এ রকম লোকের হাত তথা অনিষ্ট থেকে সমাজ নিরাপদ থাকে না। তাসাউফের মূল উদ্দেশ্যগুলো হলো-
১. আল্লাহ তায়ালার কিছু আদেশ মেনে চলা;
২. নৈতিক চরিত্র অর্জনের মাধ্যমে জীবন গঠন করা;
৩. মানুষের অন্তরাত্মাকে সজাগ ও সজীব করে তোলা।
সুতরাং, কোরআন ও হাদিসের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, তাসাউফ অর্জনের জন্য যথাযথ মাধ্যম গ্রহণ করা অপরিহার্য।

তাসাউফ মোমিনের #অন্তর্দৃষ্টি
‘তাসাউফ’ আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ সুফিবাদ, আধ্যাত্মিকতা, অধ্যাত্মবাদ। মুসলিম দর্শনে ‘তাসাউফ’ সুফিবাদ নামে খ্যাত। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুফি শব্দটি সুফ শব্দ থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ পশম। পশমি বস্ত্র সরলতা ও আড়ম্বরহীনতার প্রতীক। রাসুল (সা.) ও তার সাহাবারা বিলাসিতার পরিবর্তে সাদাসিধে পোশাক পরিধান করতেন। তাই সাদাসিধে জীপনযাপনকারী ব্যক্তিরা মুসলিম দর্শনে সুফি নামে অভিহিত। আবার কারও মতে, সুফি শব্দটি সুফফা থেকে এসেছে। প্রিয় নবী (সা.) এর সাহাবাদের মধ্যে একটি দল সামাজিক ও প্রতিকূল অবস্থার শিকার হয়ে আশ্রয় ও সম্বলহীন অবস্থায় মসজিদে নববির উত্তর পাশে অবস্থান করতেন। রাসুল (সা.) এর কাছে যে হাদিয়া আসত, তা থেকে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন ও সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন এবং সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তাদের আহলে সুফফা বলা হয়। আর আহলে সুফফা থেকেই সুফি এসেছে।
তাসাউফ বা সুফিবাদের পারিভাষিক বর্ণনায় শাইখুল ইসলাম জাকারিয়া আল আনসারি (রহ.) বলেন, ‘যে ইসলামের দ্বারা অনন্ত সৌভাগ্য লাভের উদ্দেশ্যে আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের প্রক্রিয়া এবং মানুষের জাহির ও বাতিন গঠন করা সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়, তাকে ইলমে তাসাউফ বলা হয়।’ আল্লামা শামি (রহ.) বলেন, ‘ইলমে তাসাউফ হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সৎগুণগুলোর প্রকারভেদ এবং তা অর্জনের পন্থা ও অসৎ স্বভাবগুলোর শ্রেণিবিভাগ এবং তা থেকে আত্মরক্ষার উপায় অবগত হওয়া যায়। ইলমে শরিয়ত ও ইলমে মারেফতকে অনেকে আলাদা করে দেখে; কিন্তু এ দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলী কারি (রহ.) বলেন, ‘শরিয়তের বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন না করলে মারেফত লাভ যেমন সম্ভব নয়, তদ্রƒপ ইলমে মারেফতও সঠিকভাবে না শিখলে শরিয়তের হুকুম-আহকাম ঠিকমতো আদায় করা যায় না।’
তাসাউফ সম্পর্কে নানা ধারণা পাওয়া যায়। হক্কানি আলেমরা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন, এর সপক্ষে দলিল পেশ করেছেন এবং অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ইলমে মারেফত ও ইলমে শরিয়ত পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সবসময় ইবাদতে মগ্ন থাকার দরুন ইলমে মারেফত বা তত্ত্বজ্ঞান আত্মার ওপর ইলহাম ও কাশফরূপে প্রকাশ পায়। যেমন রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার ইলম অনুযায়ী আমল করে, তাকে এমন জ্ঞান দান করেন, যা আগে তার অজানা ছিল। যা সে আমল করে, তিনি তার ভেতর তাকে তৌফিক দেন, যে পর্যন্ত তার জন্য জান্নাত অবধারিত না হয়। আর যে ব্যক্তি তার ইলম অনুযায়ী আমল করে না, সে তার ইলমের ভেতর ঘুরতে থাকে। সে যা আমল করে, তার জন্য তিনি তাকে তৌফিক প্রদান করেন না, যে পর্যন্ত না জাহান্নাম তার জন্য নিশ্চিত হয়। রাসুল (সা.) এর এ কথার সমর্থনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদাররা! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে তিনি তোমাদের ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি প্রদান করবেন।’ (সূরা আনফাল : ২৯)। প্রিয় নবী (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা মোমিনের ফিরাসাত অর্থাৎ প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টিকে ভয় করো। কেননা সে আল্লাহর নূরের সাহায্যে দেখে থাকে। (মেশকাত : ৫৫৬)। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যার বক্ষকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, সে তার প্রতিপালকের প্রদত্ত আলোয় রয়েছে।’ (সূরা জুমার : ২২)।
কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে, যার দ্বারা তাসাউফের সত্যতা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম, হক্কানি আলেম ও আওলিয়াদের জীবন থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, তাসাউফ সত্য। সুতরাং আমাদের কর্তব্য তাসাউফকে ইনকার না করা এবং জীবনকে ইলমে মারেফত তথা কুসংস্কার ও বিদাতমুক্ত তাসাউফের আলোয় আলোকিত করার চেষ্টা করা।
----আবু আফিফা

চরিত্র গঠন ও মানবিক বিকাশে শিক্ষা

** মনওয়ার সাগর **
মানুষের জ্ঞান ও চিত্তের উৎকর্ষের জন্য, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য, চরিত্র গঠন ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্য, সর্বোপরি মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষা হচ্ছে প্রধান নিয়ামক। শিক্ষা মানুষের চিন্তা ও মননকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে, জ্ঞানী করে। জ্ঞানকে সুপ্রয়োগ করলে তা হয় বিজ্ঞতা। বিজ্ঞতা সাফল্য নিশ্চিত করে। বিখ্যাত চীনা দার্শনিক কুয়ানৎসু বলেছিলেন “যদি এক বছরের পরিকল্পনা মতো ফল পেতে চাও শস্য রোপন কর, যদি দশকের ফল পেতে চাও বৃক্ষ রোপন কর, যদি সমগ্র জীবনের জন্য পরিকল্পনা করে ফল পেতে চাও তবে মানুষের সুশিক্ষার ব্যবস্থা কর।” এ একটি কথা থেকেই বুঝা যায় শিক্ষা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, জীবনকে সফল ও সার্থক করার জন্য শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষার মান দেশের মানুষের জীবনের মানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। জীবন তাহলে কী? জীবন মানেই হচ্ছে অদৃশ্য স্পন্দনের দৃশ্যমান বিকাশ, এ অদৃশ্য স্পন্দনের উৎসের কাছাকাছি যেতে হলে অনুভুতির গভীরে যেতে হবে, আত্মাকে স্পর্শ করতে হবে। আত্মার কোন মাত্রা নেই। আত্মা হচ্ছে বিশুদ্ধ শক্তি। ব্যক্তির মনোগত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আত্মা বিকশিত হয়। আর এ জন্যই জনৈক মনিষী বলেন “দৃষ্টি ভঙ্গি বদলান, জীবন বদলে যাবে।” দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতে না পারলে আত্মা পুরোনো শৃঙ্খলেই শৃঙ্খলিত থাকবে। আর এ দৃষ্টি ভঙ্গি বদলানোর জন্য যে অনুশীলন প্রয়োজন তাও শিক্ষা। সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি লেখা এবং পড়ার দুটি কৌশল আয়ত্ব করা কিন্তু ব্যাপক অর্থে চরিত্র গঠন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, চিন্তা, যুক্তি, কল্পনা ইত্যাদি শক্তির যথার্থ স্ফুরণও শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত। শিক্ষা এমন একটি ব্যবস্থা যা সমাজের চাহিদা, উৎকর্ষ ও মূল্যায়নের নিরিখে সমাজ মানসের গতিপথ নির্দেশ করে। ইংরেজী ঊফঁপধঃরড়হ শব্দটি খধঃরহ ভাষার দু’টি শব্দের বফঁপবৎব এবং বফঁপধৎব যে কোন একটি থেকে উদ্ভুত হয়েছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। প্রথম শব্দটির দু’টি অর্থ আছে ‘ব’ এবং ‘ফঁপড়’ ‘ব’ শব্দটির অর্থ ‘মধ্য হতে’ এবং ফঁপড় শব্দটির অর্থ আমি বাহিরে আনি” অর্থাৎ বফঁপধৎব শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় “আমি ভিতর থেকে বাহিরে আনি” মানুষের অন্তর্নিহিত জ্ঞানকে বাহিরে আনা বা স্ফুরিত করা। কিন্তু শিক্ষা শুধু ভিতরের বস্তুকে বাহিরে আনা নয়। এ প্রক্রিয়ায় অনেক কিছু যেমন তথ্য, প্রবৃত্তি ও প্রক্ষোভ অনুপ্রবেশ করানোর ও পূর্ণগঠনের প্রয়োজন আছে সুতরাং নৈতিক দিক থেকে এ ধারণাটি ত্রুটিযুক্ত মনে হয়। দ্বিতীয় শব্দটি বফঁপধৎব, যার অর্থ “মানুষ করে তোলা” ঞড় নৎরহম ঁঢ়, ঃড় ৎবধৎ, এ ধারণাটি বেশ সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা শিক্ষা শিল্প সৃজন মূলক দিকের প্রতি ধারণাটি যথাযোগ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। “ঙীভড়ৎফ উরপঃরড়হধৎু”র মতে ঊফঁপধঃরড়হ শব্দটি ঊফঁপধৎব থেকে উদ্ভুত বলে নির্দেশ করে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জন ডিউইও একই মতবাদে বিশ্বাসী। প্রচলিত অর্থে শিক্ষা শব্দটি ৪ (চার) প্রকারের অর্থে ব্যবহৃত হয়। ঊফঁপধঃরড়হ বা ‘শিক্ষা’ বলতে বুঝায় যে কোন বস্তু বা ব্যক্তির মাধ্যমে মানব আচরণের পরিবর্তন সাধন, এটাই শিক্ষার ব্যাপকতম অর্থ। ঊফঁপধঃরড়হ বা ‘শিক্ষা’ বলতে বুঝায় মানুষের দ্বারা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে মানবাচরণের পরিবর্তন সাধন। ঊফঁপধঃরড়হ বা ‘শিক্ষা’ বলতে বুঝায় মানুষের দ্বারা জ্ঞাতসারে পরিকল্পনা মত মানবাচরণের পরিবর্তন সাধন। ঊফঁপধঃরড়হ বা ‘শিক্ষা’ বলতে বুঝায় বিদ্যালয়ে সংগঠিত মানবাচরণের পরিবর্তন সাধন।
গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের (৮৭৩-৪০০ খ্রীঃ পৃঃ) মতে শিক্ষা হলো জিজ্ঞাসার মাধ্যমে সত্যের সন্ধান, আর এ সত্য উদঘাটনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সমপথের সহযাত্রী।
প্লেটো ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থে শিক্ষাকে (ক) জানা (খ) বিশ্বাস (গ) স্বরূপ অন্বেষা (ঘ) সমাধান ও নিশ্চয়তা এ চারটি স্তরে ব্যাখ্যা করেছেন। অ্যারিস্টটল মানুষের সুপ্ত চিন্তা চেতনার বিকাশের পন্থাকে শিক্ষা বলেছেন। দার্শনিক জাঁ জাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) শিক্ষাকে সকল কৃতিমতা মুক্ত স্বাভাবিক পথে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জার্মান শিক্ষাবিদ ফ্রেডরিক ফ্রোয়েবল (১৭৮২-১৮৫২) শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুর স্বাধীন বিকাশে তার আগ্রহ ইচ্ছা আর ক্রীড়া প্রবৃত্তির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ইংরেজ কবি Jhon Milton শিক্ষা প্রসংগে বলেছেন :Education is the harmonious development of body, mind and soul অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে শরীর মন ও আত্মার সুষম উন্নয়ন। পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদ Professor Herman H, Horne Gi g‡Z Education is the eternal process of superior adjustment of the physically and mentally developed, conscious, human being to God as manifested in the intellectual emotional and volitional environment of man. শাব্দিক অর্থে শিক্ষা হচ্ছে শারিরীক ও মানসিকভাবে মুক্ত সচেতন মানব সত্ত্বাকে স্রষ্টার সঙ্গে উন্নত ও ঐচ্ছিকভাবে সমন্বিত করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। মোট কথা মানুষের চিন্তা চেতনা, সুকুমার বৃত্তি ও সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ সাধন ও ক্রমবিকাশ করে মনুষ্যত্ব মানবিকতার উচ্চাসনে পৌঁছে দেবার মাধ্যম হলো শিক্ষা। মানুষের আত্মচেতনাবোধ ও মৌলিকত্ব সৃষ্টি করা শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মার্কিন শিক্ষাবিদ জন ডিউই (১৮৬৯-১৯৫২) বলেছেন, শিক্ষা শুধু ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নয়, বর্তমান জীবন যাপনের প্রণালীও তার অন্তর্ভূক্ত। মানব জীবনের চলমান অভিজ্ঞতাকে অর্থপূর্ণ করে তোলা এবং সে অভিজ্ঞতা থেকে তাৎপর্য আহরণ করাই হলো শিক্ষার উদ্দেশ্য।
মানবিক বিকাশ বলতে আমরা কি বুঝি? মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে, সমাজে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করতে গিয়ে তাকে বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে হয়। এ সকল চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মানুষ তার দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশ, মানসিক শান্তি এবং সামাজিক জীবনের উৎকর্ষতা সাধন করে থাকে। এই অপরিহার্য চাহিদা পূরণের মাধ্যমে যে বিকাশ সাধিত হয় তাকেই আমরা মানবিক বিকাশ বলতে পারি। মানুষের বেঁচে থাকা, জীবনের বিকাশ এবং সভ্য সামাজিক জীবন যাপনের জন্য যে সকল উপকরণ একান্তই অপরিহার্য্য, যার কোন বিকল্প নেই তাদের সমষ্টিকে মৌল মানবিক চাহিদা বলা হয়। সমাজ বিজ্ঞানী ঞড়বিষ তার বিখ্যাত ইধংরপ ঐঁসধহ ঘববফং গ্রন্থে ছয়টি প্রয়োজনকে মৌল মানবিক প্রয়োজন বলে উলে­খ করেছেন। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সবকয়টি দেশে এ ছয়টি প্রয়োজন সাংবিধানিক ভাবে মৌল মানবিক প্রয়োজন বলে উলে­খ করেছেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবকয়টি দেশে এ ছয়টি প্রয়োজন সাংবিধানিক ভাবে মৌল মানবিক প্রয়োজন হিসেবে স্বীকৃত। সেগুলো হচ্ছে (১) খাদ্য (Food) (২) বস্ত্র (Cloth) (৩) বাসস্থান (Shelter) (৪) শিক্ষা (Education) (৫) স্বাস্থ্য (Health) (৬) চিত্ত বিনোদন (Recreation) তন্মধ্যে যে সকল মানবিক প্রয়োজন মানুষকে অন্যান্য প্রসারের চেয়ে আলাদা সত্তা দান করেছে তার মধ্যে শিক্ষা হচ্ছে অন্যতম। শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সকল বিষয়ে জ্ঞান লাভের প্রধান উপায়। শিক্ষার অভাবে অধিকাংশ জনগণ অজ্ঞ, নিরক্ষর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও রক্ষণশীল মনোভাবের হওয়ায় জনসংখ্যা স্ফীতি, স্বাস্থ্য ও পুষ্ঠিহীনতা, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার অভাব ও অজ্ঞতা আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করে না, সেজন্য মানবীয় চিন্তা ভাবনা ও আচরণ কল্যাণমুখী না হয়ে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ মানবীয় চিন্তা ভাবনাকে কল্যাণমুখী করার জন্য, চিন্তার সমৃদ্ধির জন্য, চরিত্র গঠন ও মানবিক বিকাশের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
জগদ্বিখ্যাত মনিষীদের বক্তব্য থেকে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হবে। আলোচনার সুবিধার্থে নিম্নে কিছু মনিষীর বক্তব্য উপস্থাপন করা হল। ফরাসী মনীষি মন্টেইন (গড়হঃধরহ) এর মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হল নৈতিক চরিত্র গঠন। তাঁর মতে নৈতিক চরিত্র গঠিত হলে মানুষ সমস্ত সদ্ব্যবহার করতে পারে এবং প্রয়োজনে সবকিছু ত্যাগও করতে পারে।
জন লক (ঔড়যহ খড়পশ) এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল আদর্শ মানুষ তৈরি করা এবং এই আদর্শ মানবের চারটি গুণ হল নৈতিক উৎকর্ষ (ারৎঃঁব), বিজ্ঞতা (রিংফড়স), সামাজিক সদাচার (নৎববফরহম) এবং বিদ্যা (ষবধৎহরহম)। লকের মতে এ চারটি গুণের মধ্যে নৈতিক উৎকর্ষ হল সর্বপ্রধান। রুশোও (জড়ঁংংবধহ) শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনের মাধ্যমে সমাজের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করতে চেয়েছিলেন। ফ্রোয়েবেল (চৎড়বনধষ) এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল একটি সুষম পূর্ণ প্রস্ফুটিত ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করা, যার সমস্ত শক্তি সমাজের সেবায় নিযুক্ত হবে। হার্বাট (ঐবৎনধৎঃ) এর মতে নৈতিক চরিত্র গঠনই হল শিক্ষার চরম লক্ষ্য। তাঁর মতে সৎ চরিত্রের বৈশিষ্ট হল অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা (রহহবৎ ভৎববফড়স), কর্মদক্ষ (বভভরপরবহপু) বা পূর্ণ বিকাশ (ঢ়বৎভবপঃরড়হ), উদারতা (নবহবাড়ষবহপব) বা সৎ প্রকল্প (মড়ড়ফ রিষষ), বিচার বোধ (লঁংঃরপব) এবং ন্যায়বোধ (বয়ঁরঃু)। জন ডিউই (ঔড়যহ উববিু) এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল সর্বাঙ্গীন ও অপ্রতিহত বৃদ্ধি সাধন করা। এই সর্বাঙ্গীন বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধন বলতে বোঝায় মানব ব্যক্তিত্বের সামাজিক দিক, সৌন্দর্য্যানুভূতির দিক, বৌদ্ধিক দিক, কর্ম দক্ষতার দিক ও নৈতিক দিকের পূর্ণ বিকাশ সাধন। পার্শিনান (চবৎপু হঁসহ) এর মতে ব্যক্তির সৃজন ক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমেই সমাজে নুতন বস্তুর আবির্ভাব হয়। তাই তিনি মনে করেন এ শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তির ব্যক্তিতার পূর্ণ বিকাশ সাধন। হোয়াইট হেড (ডযরঃব ঐবধফ) এর মতে শিক্ষার চরম লক্ষ্য হল এমন সব ব্যক্তি সৃষ্টি করা যারা একই সঙ্গে সংস্কৃতিবান এবং কোন বিশেষ বিশেষ জ্ঞান সম্পন্ন হবে। সংস্কৃতিবান বলতে তিনি চিন্তার সক্রিয়তা, সৌন্দর্য ও মানবতা সুলভ অনুভূতির প্রতি অনুরক্তিকে বুঝিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দের (ঝধিসর ঠরাবশধহধহফধ) এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষের অন্তর্নিহিত পরমোৎকর্ষের বহিঃপ্রকাশ সাধন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষার চরম লক্ষ্য হল ‘মুক্তি’। এ মুক্তি ৩ (তিন) প্রকার। (ক) মনের মুক্তি (ভৎববফড়স ড়ভ সরহফ) (খ) হৃদয়ের মুক্তি (ভৎববফড়স ড়ভ যবধৎঃ ) (গ) সংকল্পের মুক্তি (ভৎববফড়স ড়ভ রিষষ)। প্লেটো বলেছেন মানুষ যে পূর্ণতা নিয়ে ধরাধামে আগমন করে তার যথাযথ বিকাশই শিক্ষা। সক্রেটিসের মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সত্যের আবিস্কার ও মিথ্যার বিতাড়ন। উপরোক্ত দার্শনিক ও শিক্ষাবিদদের বক্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে শিক্ষা একটি সার্বজনীন প্রথা যার কার্যকারিতা আমৃত্যু অক্ষুন্ন থাকবে। একটি সুন্দর, পবিত্র, বিশ্বাসযোগ্য জীবন গড়ার জন্য, নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনের জন্য মানব জ্ঞানের সামগ্রীক চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ শক্তি ও মনুষ্যত্বে বিকশিত হওয়ার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ড. আহমদ শরীফ বলেছেন যা জানা যায় তাই জ্ঞান, যা জানতে হয় তাই বিদ্যা আর যা শেখা বা শেখানো হয় তাই শিক্ষা। এই শেখানো শব্দটির সাথে শিক্ষকের প্রসঙ্গটি স্বাভাবিকভাবে এসে যায়। শিক্ষকই শিক্ষার প্রধান প্রাণশক্তি। শিক্ষকের পেশাকে বলা হয় একটি সৃজনশীল পেশা। ছাত্রের দৃষ্টিতে সে শিক্ষকই ভালো শিক্ষক যিনি তাঁর পড়ানোর বিষয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ। শিক্ষকতার জন্য অবিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান চর্চা অপরিহার্য কিন্তু যে শিক্ষকের জ্ঞানের বুনিয়াদ দূর্বল, যিনি সর্বক্ষণ জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত, যে শিক্ষককে বাড়ী বাড়ী গিয়ে ছাত্র পড়িয়ে অর্থ উপার্জন করে সংসার চালাতে হয়, তার পক্ষে সৃজনশীলতা প্রকাশ করার সুযোগ বা অবকাশ কোথায়। তাই শিক্ষকের অনাড়ম্বর জীবন ও মহৎ চিন্তার অনুকূল পারিবারিক আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। অবশ্য একজন ঐশ্বর্য্যবান শিক্ষকের আন্তরিক ঐশ্বর্য্য বাহ্যিক দরিদ্রতাকে ম্লান করে দিতে পারে। আর্থিক অনটন, ঐতিহ্যের অভাব, সুযোগের সীমাবদ্ধতা, ব্যক্তিগত অনাগ্রহ প্রভৃতি কারণে বহুশিক্ষকের জ্ঞানের পটভূমি আশানুরুপ বিস্তৃত নয়। অনেকের পেশাগত নীতি বোধও দৃঢ় নয়। বলা যায় এ সকল কারণে শিক্ষকের ভাবমূর্তি আজ নি®প্রভ। নি®প্রভ ভাবমূর্তি নিয়ে শিক্ষক কী শিক্ষার পরিবেশকে পর্যাপ্ত ভাবে প্রভাবিত করতে পারবেন? ছাত্রের চেতনা বোধকে উদ্ভূদ্ধ করতে পারবেন? জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জনের প্রেরণা না থাকলে যেমন কাউকে তা দান করা যায় না তেমনি শিক্ষক প্রাত্যহিক কর্মসূচি অনুসরণ না করে কেবল তার কর্তব্যের দায় সমাধা করতে চাইলে শিক্ষার লক্ষ্যও অর্জিত হয় না মানও বজায় থাকেনা। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবেনা যে শিক্ষকের মানের চেয়ে শিক্ষার মান উঁচু হতে পারে না। সমাজের চোখে শিক্ষক হবেন সকল গুণের আধার। যে কোন শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক উপাদান উলে­খযোগ্য স্থান দখল করে এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর শিক্ষকই হচ্ছেন অতি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক উপাদান। তাই শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকের জীবন যাত্রার স্বীকৃতি মান থাকা চাই। আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি শিক্ষকদের মর্যাদা প্রয়োজন। তাদের বেতন কম, সেটাও সত্য। তা নিয়ে তারা আন্দোলন করেন। কিন্তু এ ধরনের আন্দোলন তারা করেন না তাদের শিশুরা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের সুযোগ দিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। একজন শিক্ষকের প্রধান কাজ হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করা অর্থাৎ তাকে জ্ঞান দান করা, তাকে প্রয়োজনীয় নৈপূণ্য অর্জনে সহায়তা করা, তাকে সৎ আদর্শ দান করা, তার সৎ মনোভাব তৈরি করা, তার সংকল্পের (রিষষ) পুর্ণগঠন করা এবং চরিত্র গঠন করা। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জন অ্যাডামস (ঝরৎ ঔড়যহ অফধসং) বলতেন যে, শিক্ষা প্রক্রিয়া হল দুই মেরু বিশিষ্ট প্রক্রিয়া এ দু’টি হল শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। তাঁর মতে শিক্ষাক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর উপর আপন চরিত্রের প্রভাব বিস্তার করে শিক্ষক তার আচরণিক পরিবর্তন সাধন করেন। অবশ্য এ পরিবর্তন সাধনের ব্যাপারে শিক্ষক জ্ঞানের বিভিন্ন রুপকে ব্যবহার করেন। শিক্ষাবিদ অ্যাডামসন (অফধসংড়হ) অ্যাডামসের মতের প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যে, শিক্ষা হল তিন মেরু বিশিষ্ট প্রক্রিয়া আর এই তিন মেরু হল শিক্ষার্থী, পরিবেশ ও শিক্ষক। তাঁর মতে শিক্ষার মূল কথা হল শিক্ষার্থীকে তার পরিবেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক আনা এবং শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হল শিক্ষার মৌলিক সম্পর্ক। অ্যাডামসের সঙ্গে এ বিষয়ে প্রয়োগবাদীরাও একমত। শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজন একটি সপ্রাণ সজীব পরিবেশ, সম্পূর্ণতর মনুষ্যত্বে ও উন্নতর আনন্দে জেগে ওঠার পরিবেশ।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী বস্তুনিষ্ঠ দিক নির্দেশনা থাকতে হবে- যা শিক্ষার্থীদের মাঝে উন্মেষ ঘটাতে পারে আত্মপ্রত্যয়, নিয়মানুবর্তিতা, ঐতিহ্যের চেতনাবোধ, স্বাধীনতার মূল্যবোধ, আদর্শিক স্পৃহা, সৎ ও সুস্থ সাংস্কৃতিক উন্মেষ এবং বৈষয়িক বুদ্ধিবৃত্তির সাথে আত্মিক উৎসর্গ সাধনের প্রয়োগমুখিতা। দেশের জাতীয় অধ্যাপক প্রখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছিলেন- “শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি নৈতিক মানসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করা না যায় তাহলে শিক্ষা থেকে সুফল লাভ হবে না। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি বিশেষের চরিত্রে যদি কাঙ্খিত গুণাবলী প্রবিষ্ট করা না যায় তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ প্রমাণিত হবে। ব্যক্তি তথা প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে সত্যবাদিতা, সাধুতা, ন্যায়বোধ, নিরপেক্ষতা, শৃঙ্খলা, কর্তব্যজ্ঞান, দেশ সেবা, মানবিকতার মত মহৎ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটাতে হলে শিক্ষার্থীর মনে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সৃষ্টির উপযোগী অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন।
প্রস্তাবনা
১। শিক্ষানীতি একটি জাতির মানবীয়, নৈতিক, আত্মিক বৈষয়িক ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের বৃহত্তর জনগণের ধ্যানধারণা, দর্শন, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা উচিত। ২। জাতীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিতকরণ এবং শিক্ষাকে প্রকৃতার্থে স¤প্রসারিত ও গণমুখী করতে হলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে ত্বরান্বিত করতে হবে। ৩। সম্রাট নেপোলিয়নের মতে শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষিত মায়ের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। শিশুর পড়ালেখার প্রাথমিক পরিবেশ গড়ে ওঠে পরিবারের মধ্যে মা’কে ঘিরে। তাই নারী সমাজকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ৪। শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি সমূহ চিহ্নিত করে এমন শিক্ষা নীতি চালু করা উচিত যাতে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি দেশপ্রেমবোধ ও মানুষের মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। ৫। শিক্ষার চারটি মূল উপকরণ হচ্ছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষার পরিবেশ ও পাঠ্যসূচী। এ উপকরণ যদি ভাল হয় শিক্ষাও ভালো হবে। উপকরণ যদি খারাপ হয় শিক্ষার মানও খারাপ হবে। তাই উপকরণ ভালো করার জন্য পরিকল্পনা, কমৃসূচী প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও ফলাফলের মধ্যেকার সামঞ্জস্যতা বিধান করতে হবে। ৬। অভিভাবকদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অভিভাবকদের অনেকেই মনে করে থাকেন যে শ্রেষ্ঠ মানুষ মানেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথও একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসিমউদ্দিনও শ্রেষ্ঠ মানুষ, এরিষ্টটল প্লেটোও একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে হলে বড় মানুষের গুণাবলী ধারণ করতে হবে। এজন্য পারিবারিক পরিবেশ থেকেই ছেলে-মেয়েদের নৈতিক গুণ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। ৭। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যাবার আগে একটা প্রাক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষায় পরিবার অথবা মা বাবা অথবা ওইটুকু দিয়ে একটা স্কুল প্রসেসিং এ আনতে হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিকের পরে সামাজিক পর্যায়ে আসতে হবে। ৮। প্রতিটি স্কুলে লাইব্রেরী ও সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম থাকা প্রয়োজন। যাতে করে ছাত্ররা পাঠ্য বইয়ের বাইরের জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ৯। একটি জাতীয় ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে হলে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা রাখতে হবে। তাই দেশের ঐতিহ্য আশ্রিত সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ ও অপসংস্কৃতি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১০। বিদ্যা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান এমন হওয়া উচিত- যেখানে একজন ছাত্রের আত্মিক ও মানসিক বিকাশ প্রকৃতির সহচর্যে পূর্ণতা পায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের জন্য প্রাণ সৃষ্টি করতে হবে, আনন্দলোক তৈরি করতে হবে।
:: মনওয়ার সাগর : কবি, গবেষক।

আখলাকে হাসানা : গুরুত্ব ও ফযীলত

আল্লাহ বলেন, يَوْمَ لاَ يَنْفَعُ مَالٌ وَلاَ بَنُوْنَ، إِلاَّ مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ- ‘সেদিন সন্তানাদি ও মাল-সম্পদ কোন উপকারে আসবে না। উপকৃত হবে কেবল সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিকট আসবে ‘ক্বালবে সালীম’ বা নিরাপদ অন্তর নিয়ে’ (শু‘আরা ৮৮, ৮৯)। বস্ত্তত ক্বালবে সালীমের বহিঃপ্রকাশই আখলাকে হাসানা বা উত্তম চরিত্র। আখলাকে হাসানা মানব চরিত্রের প্রতিটি বাঁকে ঈমানময় আভা বিকিরণ করে। ফলে মানব চরিত্র হয়ে ওঠে শরী‘আত নির্ভর ও সৌন্দর্যের প্রতিভূ।
খবরের কাগজ খুললে দেখা যায় কাগজের শুষ্ক দেহখানির অধিকাংশই পঙ্কিল খবরে ঢাকা। অতসব অসার, অনাকাঙ্খিত খবরে ঢেকে থাকতে থাকতে সে যেন আজ বড় বিপদগ্রস্থ। বর্তমান সামাজিক অবস্থা কোন অংশে জাহেলিয়াতের যুগের চেয়ে কম নয়। এগুলো থেকে মুক্তির উপায় কি? আরব জাহেলী সমাজ যখন নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, চরিত্রহীনতার অতলে হারিয়ে যাচ্ছিল, এমনিতর সময়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এলেন আখলাকে হাসানা পরিপূর্ণতার জন্য। তিনি আখলাকে হাসানার যে বাস্তব দৃষ্টান্ত দাঁড় করিয়ে দেখিয়েছেন তার সংস্পর্শ থেকে মানব জাতি অনেক দূরে। উত্তম চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টিকে ভাল করে রপ্ত করতে না পারলে আমাদের মুক্তি ও শান্তির আশা একেবারেই ক্ষীণ। উন্নত জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদেরকে আবারও সমবেত হতে হবে আখলাকে হাসানার নিবিড় ছায়াতলে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা আখলাকে হাসানার পরিচয়, গুরুত্ব-ফযীলত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
আখলাকে হাসানার পরিচয় :
أخلاق শব্দটি বহুবচন। একবচনে خُلْقٌ বা خُلُقٌ। শাব্দিক অর্থ স্বভাব, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, অভ্যাস, বৈশিষ্ট্য, শিষ্টাচার প্রভৃতি। লুইস মা‘লূফ বলেন, الْخُلُقُ ج اخلاق : المَرُوْءَةُ، العَادَةُ، السَّجِيَّةُ، الطَّبْعُ ‘খুলুক শব্দটির বহুবচন اخلاق। আভিধানিক অর্থ ব্যক্তিত্ব, অভ্যাস, স্বভাব, জনমগত স্বভাব প্রভৃতি’ (আল মুনজিদ ফিল লুগাহ ওয়াল আ‘লাম, ১ম খন্ড (বৈরুত : দারুল মাশরিক, ১৯৭৩ইং), পৃঃ ৯৪)
حسنة শব্দের অর্থ সুন্দর, উৎকৃষ্ট, ভাল প্রভৃতি। সুতরাং আল- আখলাকুল হাসানা অর্থ : সুন্দর স্বভাব, উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্ব, ভাল অভ্যাস, উত্তম চরিত্র প্রভৃতি। পরিভাষায়, কথায়-কাজে নিরহংকার ও উত্তম আচরণ ফুটে ওঠার নাম আখলাকে হাসানা।
আল্লামা জুরজানী আখলাকে হাসানার একটি যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তৎপ্রণীত ‘কিতাবুত তা‘রীফাত’ নামক গ্রন্থে। তিনি বলেন,
الْخُلُقُ عِبَارَةٌ عَنْ هَيْئَةٍ لِلنَّفْسٍ رَاسِخَةٌ تَصْدُرُ عَنٍْهَا الْاَفْعَالُ بِسُهُوْلَةٍ وُيُسْرٍ مِنْ غَيْرٍ حَاجَةٍ اِلَى فِكْرٍ وَرَوِيَّةٍ فَإِنْ كَانَتِ الْهَيْئَةُ بِحَيْثُ تَصْدُرُ عَنْهَا الْاَفْعَالُ الْجَمِيْلَةُ عَقْلاً وَشَرْعًا بِسُهُوْلَةٍ، سُمِّيَتِ الْهَيْئَةُ خُلْقًا حَسَنًا-
‘খুলুক বা চরিত্র হচ্ছে আত্মার বদ্ধমূল এমন একটি অবস্থা, যা থেকে কোন চিন্তা-ভাবনা ব্যতীতই অনায়াসে যাবতীয় কার্যকলাপ প্রকাশ পায়। আত্মার ঐ অবস্থা থেকে যদি বিবেক-বুদ্ধি ও শরীআতের আলোকে প্রশংসনীয় কার্যকলাপ প্রকাশ হয় তবে তাকে আখলাকে হাসানা নামে অভিহিত করা হয় (শরীফ আলী বিন মুহাম্মাদ আল  জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃঃ ১০১। অর্থাৎ কোন মানুষের নিকট থেকে যদি স্বভাবগতভাবে প্রশংসনীয় আচার-আচরণ প্রকাশ পায় তবে তাকে আখলাকে হাসানা বলা হয়।
Oxford dictionary তে বলা হয়েছে- Character is the particular combination of qualities in a person that makes him different from other. It is such a quality which leads a man to be determined and able to bear dificulties. ‘চরিত্র হচ্ছে কোন মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো স্বতন্ত্র গুণাবলীর সমাবেশ, যা মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। এগুলো এমন কিছু গুণ, যা মানুষকে সংকল্পবদ্ধ হতে ও কঠিন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে।
হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, حُسْنُ الخُلُقِ بَسْطُ الْوَجْهِ وَبَذْلُ النَّدَى وَكَفُّ الْأََذَىَ ‘সচ্চরিত্র হল হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, দানশীলতা এবং কাউকে কষ্ট না দেয়া’ (আবূ বকর আল জাযাইরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃঃ ১১৫)।
আখলাকের প্রকারভেদ :
আখলাক বা চরিত্র দুই প্রকার। যেমন (১) আখলাকে হাসানা বা সচ্চরিত্র (২) আখলাকে সায়্যিয়াহ বা মন্দ চরিত্র (সম্পাদনা পরিষদ, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৬ইং), পৃঃ ৭১৫)। শরী‘আত যে সমস্ত স্বভাব-কর্মের জন্য মানুষকে প্রশংসিত ও উৎসাহিত করে তাকে আখলাকে হাসানা বলে। আর যে সমস্ত স্বভাব-কর্মের জন্য নিন্দিত ও তিরষ্কৃত করেছে তাকে আখলাকে সায়্যিয়াহ বলে। আল্লামা জুরজানী বলেন, অন্তর থেকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও শরী‘আতের আলোকে যে সমস্ত প্রশংসনীয় আচরণ প্রকাশ পায় তার নাম সচ্চচিত্র। আর যদি স্বভাবগতভাবে মন্দকর্ম সমূহ প্রকাশ পায় তার নাম মন্দ চরিত্র (আল-আখলাকুল ফাযেলা, পৃ: ৩১)
উল্লেখ্য, মানুষের দু’এক দিনের আচরণ তার স্বভাব বা চরিত্র হতে পারে না। বরং সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র তখনই বলা হবে যখন এগুলো স্বভাবগতভাবে প্রকাশ পাবে। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ বিন সাইফুল্লাহ বলেন, আমরা বলি, এটি (সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র) একটি বদ্ধমূল বা স্থায়ী অবস্থা। যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে সম্পদ ব্যয় করে তাকে দানশীল বলা যাবে না। কারণ এটি তার নিজস্ব স্বভাবে নেই। অনুরূপভাবে কেউ রাগের সময় কষ্ট করে চুপ করে থাকার ভান করলে তাকেও ধৈর্যশীল বলা যাবে না  (আল-আখলাকুল ফাযেলা, পৃঃ ৩১)। মোট কথা, স্বভাবগত উত্তম ও প্রশংসনীয় কর্ম সমষ্টির নাম আখলাকে হাসানা। আর স্বভাবগত মন্দ কর্ম সমষ্টির নাম আখলাকে সায়্যিয়াহ।
আখলাকে হাসানার গুরুত্ব ও ফযীলত :
আখলাকে হাসানার প্রতি শরী‘আত যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে ঔষধ প্রয়োগ করলে যেমন তা সহজেই শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যায়, তেমন আখলাকে হাসানা নামের সজীব বৃক্ষটির মযবুত পরশে মানব জীবনের প্রতিটি পরত হয়ে ওঠে ক্লেশমুক্ত, নির্ঝঞ্ঝট ও পরিচ্ছন্ন। তাই উভয় জাহানে সফলতা লাভের মানদন্ড নিরূপণ করা হয়েছে আখলাকে হাসানাকে। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিকে প্রর্বোত্তম মানুষ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمُ أَحْسَنَكُمْ أَخْلاَقًا ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে ভাল’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৪, ৯/১৬৮, ‘কোমলতা, লাজুকতা ও সচ্চরিত্রতা’ অনুচ্ছেদ)
তিনি বলেন, مَا شَيْئٌ اَثْقَلَ فِىْ مِيْزَانِ المُؤْمِنِ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ خُلْقٍ حَسَنٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের দাঁড়িপাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে জিনিসটি রাখা হবে তা হচ্ছে উত্তম চরিত্র’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০২, সনদ ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূদাঊদ হা/৪৭৯৯, ‘সচ্চরিত্র’ অধ্যায়)। আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَا مِنْ شَيْئٍ يُوْضَعُ فِى المِيْزَانِ اَثْقَلُ مِنْ حُسْنِ الخُلْقِ، شَأنَ صَاحِبِ حُسْنِ الخُلْقِ لَيَبْلُغُ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ وَالصَّلاَةِ. ‘মুমিনের মিযানের পাল্লায় সচ্চরিত্র অপেক্ষা ভারী কোন কিছুই রাখা হবে না। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বদা (দিনে) ছিয়াম পালনকারী ও (রাতে) ছালাত আদায়কারীর ন্যায়’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০৩, সনদ ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৭৯৮)। দিনভর ছিয়াম রেখে, রাতভর ছালাত আদায় করে কোন ব্যক্তি যে নেকী পাবেন, সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি তার সচ্চরিত্রের কারণে সে পরিমাণ নেকীর ভাগীদার হবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে তার চরিত্রকে সুন্দর করেছে, আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য যামিন হব’ (তাহক্বীক্ব আবূদাঊদ, হা/৪৮০০, সনদ ছহীহ)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَكْمَلُ الْمُؤْمِنِيْنَ اِيْمَامًا اَحْسَنُكُمْ خُلُقًا، وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ خُلُقًا- ‘ঈমানের দিক দিয়ে সর্বাধিক কামিল সে ব্যক্তি, যার চরিত্র সর্বোত্তম। তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা স্ত্রীদের সাথে সর্বোত্তম আচরণকারী’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/১১৬২; সনদ হাসান ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৬৮২)। কামিল মুমিন হওয়ার জন্য অত্র হাদীছে চরিত্রের কামালিয়াত শর্তারোপ করা হয়েছে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল কোন জিনিস মানুষকে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি বলেন, আল্লাহভীতি ও সচ্চরিত্র। আবারও জিজ্ঞাসা করা হল, কোন জিনিস বেশি জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান’ (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০৪, সনদ হাসান)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, সৎ কাজ হল উত্তম স্বভাব। আর পাপ কাজ হল,  যে কাজ তোমার অন্তরে সন্দেহের সৃষ্টি করে। তুমি ঐ কাজটি জনসমাজে প্রকাশ পাওয়াটা অপছন্দ কর (মুসলিম, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫২, ৯/১৬৭)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَىَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّى مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلاَقًا  ‘তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র সর্বোত্তম সে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। আর ক্বিয়ামত দিবসেও সে আমার কাছাকাছি অবস্থান করবে (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০১৮, সনদ ছহীহ)। এমন আশাব্যঞ্জক হাদীছ গভীরভাবে পড়লে নিশ্চয়ই তাক্বওয়াশীল হৃদয় উত্তম চরিত্র অর্জনে উদ্বুদ্ধ হবে। মুযায়না গোত্রের এক ব্যক্তি বলেন, সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোন জিনিসটি সর্বোত্তম যা মানব জাতিকে দেয়া হয়েছে? তিনি বলেন, সচ্চরিত্র (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫০৭৮, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৭, ৯/১৬৯)
রাসূল (ছাঃ) বলেন, بُعِثْتُ لِاُتَمِّمَ حُسْنَ الاخلاقِ ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫০৯৭, সনদ হাসান, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৭০, ৯/১৭২)। রাসূল (ছাঃ) ছিলেন সচ্চরিত্রের মূর্তিমান আদর্শ। তাঁর চরিত্রের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন, واِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْم ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (ক্বলাম ৪)। তিনিও তার চরিত্রকে আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করার জন্য বলতেন, اللهم حَسَّنْتَ خَلْقِىْ فَاَحْسِنْ خُلُقِىْ ‘হে আল্লাহ তুমি আমার গঠন সুন্দর করেছ, সুতরাং আমার চরিত্রকে সুন্দর কর (আহমাদ, তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫০৯৯, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৭২, ৯/১৭৩)। সুতরাং সচ্চরিত্র মানব জীবনের জন্য কতটা প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ, তা এই হাদীছ থেকে সহজেই অনুমেয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, আমি কি তোমাদেরকে বলব না, তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি কে? তাঁরা বললেন, অবশ্যই। তিনি (ছাঃ) বলেন, তোমাদের মধ্যে তিনিই সর্বোত্তম, যিনি বয়সে বড় এবং স্বভাব-চরিত্রে ভাল (আহমাদ, মিশকাত হা/৫১০০, সনদ ছহীহ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দিব না, যার উপর জাহান্নাম হারাম আর জাহান্নাম যার জন্য হারাম? তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার মেজায নরম, কোমল স্বভাব, মানুষের সাথে মিশুক এবং সহজ-সরল (আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০৮৪, সনদ ছহীহ)। উল্লিখিত হাদীছগুলো থেকে আমরা সচ্চরিত্রের ফযীলত জানতে পেরেছি। সচ্চরিত্রের কারণে একজন মানুষকে সর্বোত্তম ঘোষণা করা হয়েছে। বিভীষিকাময় ক্বিয়ামত কালে আল্লাহ যখন চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ চুকাতে মানব আমল মিযানের পাল্লায় তুলবেন, তখন সচ্চরিত্র সেŠভাগ্যের স্বপ্নকাঠি হয়ে সবচেয়ে বেশি ভারী হবে। ব্যক্তির উত্তম-ভাল স্বভাবগুলো তার দুর্দিনে কতটা ফলদায়ক হবে, তা সে কল্পনাও করতে পারবে না। সচ্চরিত্রের জন্য সে ‘ছাহেবুছ ছাওম’ অর্থাৎ সারা বছর ছিয়াম পালনকারী ও ‘ছাহেবুছ ছালাত’ অর্থাৎ সারারাত ছালাত আদায়কারীর ন্যায় ছওয়াব পাবে। হাদীছে সচ্চরিত্রের জন্য এত এত নেকী ও মর্যাদা ঘোষণা করাতে সচ্চরিত্রের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ফুটে ওঠেছে। বস্ত্তত সচ্চরিত্র সামাজিক শৃংখলার হাতিয়ার। এটি ব্যতীত সুখ-শান্তির কল্পনা অবান্তর। সচ্চরিত্র অর্জনে আমাদের অনুপ্রাণিত হওয়া, প্রচেষ্টা চালানো একান্ত কর্তব্য।
আখলাকে সায়্যিয়াহ বা মন্দ চরিত্রের পরিণতি :
শরী‘আত বিভিন্ন ফযীলতের ঘোষণা দিয়ে যেমন আখলাকে হাসানা অর্জনে উৎসাহিত করেছে ও তাকীদ দিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন মন্দ পরিণতি ও শাস্তির হুঁশিয়ার করে অপছন্দনীয় ও নিন্দিত স্বভাব বর্জনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ব্যক্তির মন্দ স্বভাব তার জান্নাত হারানোর অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ الجَّوَّاظَ وَلاَ الْجَعْظَرِىُّ ‘দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে যাবে না’ (তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৮০১, সনদ ছহীহ)। মন্দ স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য তো এই একটি হাদীছই যথেষ্ট যে, তার লালিত মন্দ স্বভাব জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম বাধা হবে।
অন্য একটি হাদীছে এসেছে-
عن ابى هريرة رضي الله ان رسول الله صلى الله عليه وصلم قال اَتَدْرُوْنَ مَا لْمُفْلِسُ قَالُوْا الْمُفْلِسُ قِيْنَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ فَقَالَ اِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ اُمَّتِىْ مَنْ يَأْةِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بصَّلَوةٍ وَّصِيَامٍ وَزَكَاَةٍ وَّيَأْتِىْ قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَف هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَ سَفََكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فاِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ اَنْ يَقْضَى مَا عَلَيْهِ اُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِمْ … طُرِحَ فِى النَّار-
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কি জান অভাবী কে? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী যার টাকা-কড়ি ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত আদায় করে আসবে এবং সাথে সাথে সেই লোকেরাও আসবে, কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল-সম্পদ আত্মসাত করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এই হক্বদারকে (ছালাত-ছিয়াম নিয়ে আগমনকারী) তার নেকী দেয়া হবে। আবার ঐ হকদারকেও (পূর্বোক্ত হক্বদার যার উপর যুলুম করেছিল) তার নেকী দেয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে গিয়ে যদি তার (প্রথমতো ব্যক্তির) নেকী শেষ হয়ে যায় তবে তাদের (পরের হক্বদারের) গুণাহসমূহ ঐ ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে (প্রথম হক্বদারকে) জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯০০, ৯/১৮৪)
ব্যক্তির মন্দ চরিত্র কিভাবে তাকে নাজেহাল করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে অত্র হাদীছটি তার বাস্তব চিত্র। সে আমলকারী কতই না হতভাগা, যে আমল করেছে কিন্তু মজ্জাগত বদ অভ্যাসগুলো ছাড়তে পারেনি। ফলে এই অভ্যাসগুলো তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে ছেড়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لايَدْخُلُ الجَّنَّةَ قَتَّاتٌ ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (মুত্তাফাক্ব, মিশকাত হা/৪৬১২,  ৯/৮০, ‘জিহবার সংযম, গীবত ও গাল-মন্দ অনুচ্ছেদ)। যেসব ব্যক্তি নিজের স্বার্থের জন্য সত্য ও ন্যায়কে পাশ কাটিয়ে পরিস্তিতির অনুকূলে কথা বলে তাদের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَجِدُوْنَ شَرَّ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ذَا الْوَجْهَيْنِ الذِّىْ يَأْتِىْ هَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ وَهَؤُلاَءِ بِوْجْهٍ ‘ক্বিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তিকে তোমরা সর্বাধিক মন্দ অবস্থায় পাবে, যে দ্বিমুখী। সে এক মুখ নিয়ে এদের কাছে আসে, আরেক মুখ নিয়ে ওদের কাছে যায় (মুত্তাফাক্ব, মিশকাত হা/৪৬১১, ৯/৮০)
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ مَنَّانٌ ولاعَاقٌ ولامُدْمِنُ خَمْرٍ ‘উপকার করে খোঁটা দানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও সর্বদা মদ পানকারী জান্নাতে যাবে না’ (মিশকাত হা/৪৭১৬, ৯/১১৯, ‘সৎ কাজ ও সদ্ব্যবহার’ অনুচ্ছেদ; তাহক্বীক্ব নাসাঈ হা/৫৬৭২, সনদ ছহীহ)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, المؤمِنُ غِرٌّكَرِيْمٌ وَالفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ ‘মুমিন হয় সরল ও ভদ্র, পক্ষান্তরে পাপী হয় ধূর্ত ও দুশ্চরিত্রের (তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৭৯০, সনদ হাসান)
রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, اَلاَ اُخْبِرُكُمْ بِاَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ وفى روابة لمسلم جَوَّاظٍ رَنِِيْمٍ مُتَكَبِّرٍ- ‘আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নাম বাসীদের সম্পর্কে সংবাদ দিব না? তারা হচ্ছে অনর্থক কথা নিয়ে বিবাদকারী, বদ মেজাজী, অহংকারী’ (মুত্তাফাক্ব আলইহ)। মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে তারা হচ্ছে বদ মেজাজী, কুখ্যাত, অহংকারী (মিশকাত হা/৪৮৮৯, ৯/১৭৬, ক্রোধ ও অহংকার অনুচ্ছেদ)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَبْغَضَكُمْ إِلَىَّ وَأَبْعَدَكُمْ مِنِّى مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الثَّرْثَارُونَ وَالْمُتَشَدِّقُونَ وَالْمُتَفَيْهِقُونَ ». قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَدْ عَلِمْنَا الثَّرْثَارُونَ وَالْمُتَشَدِّقُونَ فَمَا الْمُتَفَيْهِقُونَ قَالَ «الْمُتَكَبِّرُونَ». ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিরা আমার নিকট ঘৃণ্য ও ক্বিয়ামতের দিন আমার নিকট থেকে দূরে অবস্থান করবে যারা বাচাল, নির্লজ্জ ও মুতাফাই-হিকুন। ছাহাবীগণ বললেন, বাচাথ ও নির্লজ্জ তো বুঝলাম। কিন্তু মুতাফাইহিকুন  কারা, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, অহংকারীরা (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০১৮, সনদ ছহীহ)। কোন মানুষের গঠন-আকৃতি, পোষাক-আষাক নিম্নমানের হলেই তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে তাকে হেয় মনে করা উচিত নয়। আল্লাহ বলেন,   ‘হে ঈমানদারগণ! পুরুষরা যেন পুরুষদের ঠাট্টা না করে। হতে পারে (যাদেরকে ঠাট্টা করা হচ্ছে) তাদের মধ্যে এদের চেয়ে উত্তম লোক আছে। আর মহিলারা যেন মহিলাদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তাদের মধ্যে এদের চেয়ে ভালো লোক আছে (হুজুরাত ১১)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, কোন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে (মুসলিম, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করব। (১) যে আমার সাথে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে (২) যে ব্যক্তি কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে (৩) যে ব্যক্তি কোন শ্রমিক নিয়োগ করে কাজ আদায় করে কিন্তু তার মজুরী পরিশোধ করে না (বুখারী, ৪/৯১; ‘ওয়াদা খেলাফ করা হারাম’ অনুচ্ছেদ)। ক্বিয়ামতের দিন ওয়াদা খেলাফকারীর জন্য তার ওয়াদা খেলাফের মাত্রা অনুযায়ী দুই নিতম্ব বরাবর পতাকা উত্তোলন করা হবে (ঐ, হা/১৫৮৬, ৪/৯১)। আর বলা হবে এটি অমুকের ওয়াদা খেলাফের পতাকা (ঐ, হা/১৫৮৫, ৪/৯০)
কোন মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট দেয়া ও তার দোষ খোঁজা মন্দ স্বভাব। তার পরিণতিও মন্দ। আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوْا فَقَدِ احْتَمَلُوْا بُهْتَاناً وَإِثْماً مُّبِيْنًا- ‘যারা মুমিন নর-নারীকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা অতি বড় মিথ্যা দোষ ও জঘন্য পাপের শাস্তি তাদের নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নেয় (আহযাব ৫৮)
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া মন্দ স্বভাব। আর তার শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তার সহচর হিসাবে একজন শয়তান নিয়োগ করেন। আর শয়তান যার বন্ধু হয় তার মন্দের ব্যাপারে আর কি-ই-বা বলা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَاناً فَهُوَ لَهُ قَرِيْنٌ ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয়, আমি তার জন্য নিয়োগ করি এক শয়তান। আর সে হয় তার বন্ধ’ু (যুখরূফ ৩৬)। শুধু তাই নয়, এমন ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠবে। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنكاً وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى- قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِيْ أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا- ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ, তার জীবন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠাব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন’ (ত্বহা ১২৪, ১২৫)
মানুষের মন্দ স্বভাব ও তার পরিণতির যৎসামান্যই এখানে উদ্ধৃত হল। আসল কথা এগুলোর একেকটির পৃথক পৃথক প্রবন্ধ হওয়া প্রয়োজন। যাই হোক, হাদীছগুলো থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তির মন্দ স্বভাব, চাই তা কাউকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধ হোক কিংবা বদ মেজাজের মত ব্যক্তিগত দোষই হোক পরিণামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় তাকে অনন্ত শাস্তির দিকে।
সুতরাং আমাদের মধ্যে যত ছোট-বড় বদ অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এগুলোকে গুরুত্বের সাথে নাফসে লওয়্যামার পর্যবেক্ষণে আনতে হবে। অতঃপর তাক্বওয়া নামক শক্তিশালী ক্লিনার দিয়ে ক্রমে এগুলো পরিস্কার করে ফেলতে হবে। যদি আমরা তাতে অক্ষম হই তাহলে উপরোক্ত হাদীছের পরিণাম ফল কারা ভোগ করবে?
আখলাকে হাসানার উপাদান :
মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আখলাক বিস্তৃত। আমলনামা শুরু হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এটি পরিব্যপ্ত। সে দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের আখলাক তার প্রতিটি কাজই। ফলে মানুষের ভাল-মন্দ গুণাগুণের শেষ নেই। তথাপি কিছু ভাল বা মন্দগুণের কারণে সে সমাজে উত্তম চরিত্র বা মন্দ চরিত্রে অভিহিত হয়। এমন কিছু উল্লেখযোগ্য উত্তম চরিত্রের উপাদান হচ্ছে- তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি, বিনয়-নম্রতা, সত্যবাদিতা, মিতভাষিতা, দানশীলতা, ছবর বা ধৈর্য, ক্ষমা-উদারতা, শোকর ও যিকির-আযকার, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, আল্লাহর উপর ভরসা করা, লজ্জাশীলতা, আমানতদারিতা, সুধারণা পোষণ, সৃষ্টিজীবের সকলের প্রতি সহনশীল হওয়া, আদল-ইনছাফ প্রভৃতি।
সমাপনী :
আনাস (রাঃ) বলেন, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَضَحِكَ فَقَالَ « هَلْ تَدْرُونَ مِمَّ أَضْحَكُ ». قَالَ قُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ « مِنْ مُخَاطَبَةِ الْعَبْدِ رَبَّهُ يَقُولُ يَا رَبِّ أَلَمْ تُجِرْنِى مِنَ الظُّلْمِ قَالَ يَقُولُ بَلَى. قَالَ فَيَقُولُ فَإِنِّى لاَ أُجِيزُ عَلَى نَفْسِى إِلاَّ شَاهِدًا مِنِّى قَالَ فَيَقُولُ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ شَهِيدًا وَبِالْكِرَامِ الْكَاتِبِينَ شُهُودًا – قَالَ – فَيُخْتَمُ عَلَى فِيهِ فَيُقَالُ لِأَرْكَانِهِ انْطِقِى. قَالَ فَتَنْطِقُ بِأَعْمَالِهِ – قَالَ – ثُمَّ يُخَلَّى بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْكَلاَمِ -قَالَ – فَيَقُولُ بُعْدًا لَكُنَّ وَسُحْقًا. فَعَنْكُنَّ كُنْتُ أُنَاضِلُ- ‘একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ছিলাম, হঠাৎ তিনি হেসে ওঠলেন, এমনকি তাঁর দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে পড়ল। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা কি জান আমি কেন হাসলাম? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামত দিবসে বান্দা তার প্রতিপালকের সাথে তর্কে লিপ্ত হবে; একারণে আমি হেসেছি। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমাকে যুলুম থেকে রক্ষা করেননি? আল্লাহ বলবেন, কেন নয়, অবশ্যই। সে বলবে, আমার জন্য আমি ব্যতীত অন্য কাউকে সাক্ষী হিসাবে গ্রহণ করব না। আল্লাহ বলবেন, আজকের দিনে তোমার হিসাবের জন্য তুমিই যথেষ্ট। আর সম্মানিত ফেরেশতাগণ সাক্ষী হিসাবে থাকবে। অতঃপর তার মুখে মোহর মেরে দেয়া হবে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলা হবে, কথা বল। অতঃপর তারা তার আমল সম্পর্কে বলে দেবে। অতঃপর তার যবান খুলে দেয়া হবে। সে বলবে, দূর হও, অভিশাপ তোমাদের জন্য। তোমরা আমার শত্রু হয়ে গেলে? অথচ তোমাদের জন্যই আমি ঝগড়া-বিবাদ করছিলাম (মুসলিম, মিশকাত/ ৫৫৫৪)।
কি ভয়ংকর হাদীছ! আদর-যত্নে লালিত, বিলাস-ব্যসনে পরিবেষ্টিত, সুদৃষ্টিতে সংরক্ষিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এই আচরণ! সার্বক্ষণিক সাথী দেহের এই নিষ্ঠুর নির্দয় ও বিরুদ্ধ সাক্ষ্য প্রদান কতই না মর্মান্তিক। আর তা বান্দার অস্বীকার করার কোন উপায় থাকবে না। দুশ্চরিত্রের সাঁড়াশি যেভাবে মানব জাতির শ্বাসরোধ করে রেখেছে তাতে সেদিন অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? নিজ ঘরের নীরব কোণে একাকী বসে সে ব্লু ফিল্ম দেখেছে, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল প্রভৃতি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কত মন্দ কাজে জড়িত হয়েছে, মোবাইলে কত পাপ বিজড়িত কথা বলেছে, কত ভ্রান্ত-বাতিল পরিকল্পনা করেছে! কেউ দেখেনি, কেউ শুনেনি। কারো দেখার বা শুনার অধিকারও ছিল না। আজ কি-না তা বিশ্ববাসীর নিকট ওপেন সিক্রেট! এমন অনিবার্য, অলংঘণীয় কঠিন দিনের উপস্থিতির স্মরণে মুমিন হৃদয় ডুকরে না কেঁদে পারে? যে স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, আমল মানুষকে এমনতর বিপদ ও অপমানের বদ্ধভূমিতে নিক্ষেপ করবে, আমরা তা থেকে হাতজোড় করে আমাদের রবের নিকট পানাহ চাই। আর যে চরিত্র ক্বিয়ামতের দিন মিযানকে হেলিয়ে দিয়ে বান্দার মুখ উজ্জ্বল করবে, অনাবিল জান্নাতী সুখানুভূতিতে অবগাহন করাবে, আমরা সে চরিত্র অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি। আল্লাহ তুমি সহায় হও। আমীন!

উত্তম চরিত্র গঠনের উপায়
উত্তম চরিত্র হচ্ছে ঈমানের প্রমাণবাহী ও প্রতিফলন। চরিত্র ব্যতীত ঈমান প্রতিফলিত হয় না। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ঈমানদার হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ –সুনানে আবু দাউদ

ইসলামের ইবাদতসমূহ চরিত্রের সঙ্গে কঠোরভাবে সংযুক্ত। যে কোনো ইবাদত একটি উত্তম চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায়। যেমন নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়;  নামাজ একজন মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে রক্ষা করে আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি সাধনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে।’ -সূরা আল আনকাবুত: ৪৫

ইসলামে উত্তম চরিত্র গঠনের কিছু মৌলিক বিষয় পরিলক্ষিত হয়। যা উত্তম চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট উপায় বলে মনে করা হয়। সেগুলো হলো-

সত্যবাদিতা : আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূল (সা.) আমাদেরকে সে সব ইসলামি চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতা। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। -সূরা আত তওবা: ১১৯

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেন, তোমরা সততা অবলম্বন কর। কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়।

আমানতদারিতা : উত্তম চরিত্রের একটি দিক হচ্ছে আমানতদারিতা। আল্লাহতায়ালা আমানতদারিতার বিষয়ে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানতসমূহ তার হকদারদের নিকট পৌঁছে দিতে। -সূরা আন নিসা: ৫৮

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ গুণের জন্যেই তার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আল-আমিন উপাধি লাভ করেছিলেন।

বিনয় ও নম্রতা : উত্তম চরিত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে বিনয় ও নম্রতা। একজন মুসলমান তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরীব হোক। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো- ‘তুমি তোমার পার্শ্বদেশ মুমিনদের জন্য অবনত করে দাও।’

পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার : পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা উত্তম চরিত্রের অন্যতম। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো।’ -সূরা আন-নিসা: ৩৫

এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মাতা-পিতার প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য আয়াতে তিনি তাদের প্রতি দয়া ও বিনয়পূর্ণ আচরণ এবং তাদের জন্য দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা : আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব। আর তা ছিন্ন করা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং এটা অভিশাপের কারণ। কোরআনে এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ওই সব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহতায়ালা অভিশাপ করেছেন। তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।’ -সূরা মুহাম্মদ: ২২-২৩

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে ইরশাদ করেছেন, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে না। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

অঙ্গীকারপূর্ণ : উন্নত চরিত্র গঠন করার ক্ষেত্রে এ দিকটি ভালোভাবে পালন করতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।’ -সূরা ইসরা: ৩৪

তাছাড়া হাদিসে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাকে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার : প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা উত্তম চরিত্রের অন্যতম দিক। প্রতিবেশী বলা হয় সেসব লোককে যারা আমাদের বাড়ির চারপাশে বসবাস করে। প্রতিবেশীদের প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।’ -সূরা আন নিসা: ৩৬

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জিবরাঈল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওসিয়ত করছিল, এমনকি আমি ধারণা করে নিলাম যে, প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেওয়া হবে।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম

ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা : ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা হলো উত্তম চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরমাদ হয়েছে, ‘আর যে ধৈর্য্যধারণ করলো এবং ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভুক্ত’। -সূরা আশ শুরা: ৪৩

লজ্জা : এটা এমন একটি চরিত্র যা পরিপূর্ণতা ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে আহ্বান করে। লজ্জা আল্লাহর পক্ষ হতে হয়ে থাকে। ফলে মুসলমান লজ্জা করে যে, আল্লাহ তাকে পাপাচারে লিপ্ত দেখবে। অনুরূপভাবে মানুষের থেকে এমনকি নিজের থেকেও সে লজ্জা করে। লজ্জা অন্তরে ঈমান থাকার প্রমাণ বহন করে। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।’ –বোখারি ও মুসলিম

ন্যায়পরায়ণতা : ন্যায়পরায়ণতা আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচন করে। আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘ইনসাফ করো, এটা তাক্বওয়ার অতীব নিকটবর্তী।’ –সূরা মায়িদা: ৮

দয়া ও করুণা : এ চরিত্রটি অনেক মানুষের অন্তর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের অন্তর পাথরের মতো কিংবা তার চেয়ে অধিক শক্ত হয়ে গেছে। আর প্রকৃত মুমিন হচ্ছে দয়াময়, পরোপকারী ও গভীর অনুভূতিসম্পন্ন উজ্জ্বল অনুগ্রহের অধিকারী। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা, অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মতো। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।

চারিত্রিক পবিত্রতা: উত্তম চরিত্রের অন্যতম বিষয় হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা। আল্লাহতায়ালা এ বিষয়ে বলেন, ‘যাদের বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, তারা যেন চারিত্রিক পবিত্রতা গ্রহণ করে। যতক্ষণ না আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাকে সম্পদশালী করেন।’ -সূরা আন নূর: ৩৩

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে, সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন সে যেন তার খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত কর। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত কর। তোমাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করো।’

নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত কতিপয় বিষয়

সংকলন : মো. আশিফুর রহমান


সমাজ ও জাতিসমূহের উন্নতি বিধানের ক্ষেত্রে আচার-আচরণ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মানুষের অন্তরের সুখ-শান্তি ও আনন্দ বিধানের ক্ষেত্রে আচার-আচরণের যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তা কেউ অস্বীকার করে না। উন্নত আচার-আচরণ এত প্রয়োজনীয় যে,যে সব জাতি ধর্মে বিশ্বাস করে না,তারাও একে সম্মান করে এবং এটা বিশ্বাস করে যে,জীবনের এই কঠিন পথে অগ্রগতি সাধন করতে হলে তাদেরকে অবশ্যই কিছু নৈতিকতার বিধি মেনে চলা দরকার। আমরা উন্নত বিশ্বের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই যে,সেখানে ধর্ম-কর্ম পালন করাকে তারা খুব প্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনে করে না; কিন্তু নীতি-নৈতিকতার অনেক বিষয় তারা খুব কঠোরভাবে মেনে চলে। যেমন তারা মিথ্যা কথা বলে না,প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না,যে সব কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করা হয় সেগুলো যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়,সময়ের গুরুত্ব দেয় ইত্যাদি। আর এরকম কিছু কিছু নীতি মেনে চলার ফলেই আজ তারা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পেরেছে।
ইসলাম মানুষকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং তার ওপর অনেক দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং একই সাথে অন্য মানুষের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে। কারণ,সমাজে বসবাসের জন্য অন্যের সাথে আচরণের দিকটিই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। তাই আচরণের গুরুত্ব অপরিসীম- কি আমাদের জীবন পথে চলার জন্য,কি আখেরাতে মুক্তির জন্য। উত্তম আচরণ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : `সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যসমূহ যা আমার উম্মতকে বেহেশতে দাখিল করবে তা হচ্ছে আল্লাহর ভয় ও উত্তম আচরণ।’
মহানবী (সা.) আরও বলেছেন : ﹼ `তোমাদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা উত্তম যার নৈতিক চরিত্র ও আচরণ ভাল।’
অন্য একটি হাদীসে এসেছে : `তোমাদের মধ্যকার সর্বাধিক চরিত্রবান ব্যক্তিই সর্বোত্তম।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : `সেই মুমিনই ঈমানে পূর্ণতর যে চরিত্রে অধিকতর উত্তম।’ 
উত্তম চরিত্র সম্পর্কে আলী (আ.)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেন : `হে আলী! উত্তম চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত তিনটি কাজ : যে ব্যক্তি তোমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তার সাথে সম্পর্ক গড়বে,যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে তুমি দান করবে আর যে তোমার প্রতি অন্যায় করেছে তাকে তুমি ক্ষমা করবে।’
মানুষের সাথে আচরণ সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) বলেন : `মানুষের সাথে দেখা হলে এমন আচরণ করবে যেন তোমার মৃত্যুতে তারা কাঁদে এবং তুমি বেঁচে থাকলে তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করে।’
রাসূলুল্লাহ্ মন্দ স্বভাবের অধিকারীদের ঘৃণা করতেন। তিনি বারবার বলেছেন : `মন্দ স্বভাব হচ্ছে খারাপ এবং বদ স্বভাবের অধিকারী লোক তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : `আল্লাহ তা`আলার নিকট সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট হল সেই ব্যক্তি যার অশালীন ও অসভ্য আচরণ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ তাকে পরিত্যাগ করে।’
নম্র ব্যবহার সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন : `নিশ্চয় আল্লাহ হলেন নম্র ও দয়ার্দ্র,তিনি প্রতিটি বিষয়ে নম্রতা ও দয়া প্রদর্শন পছন্দ করেন।’
তিনি আরও বলেন : `যে ব্যক্তি নম্র স্বভাব বঞ্চিত,সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।’১০
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণ সম্পর্কে হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেন : `নবী (সা.) যখন কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথা বলতেন তখন সে মুখ ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর মুখ ফিরিয়ে নিতেন না এবং যখন কারও সাথে মুসাফাহা করতেন,তখন সে তার হাত সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তিনি তার নিকট থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতেন না। তাঁর সাথে উপবিষ্ট লোকদের দিকে পা ছড়িয়ে দিয়ে তাঁকে কখনও বসতে দেখা যায়নি।’১১
রাসূল (সা.) বলেন, `নিঃসন্দেহে নম্রতা মানুষের মর্যাদাকে সুউচ্চ করে। সুতরাং বিনয়ী হও যেন আল্লাহ তোমাদের সম্মান দান করেন।’১২
রাসূল (সা.) আরও বলেন :  `ভদ্রলোকের অলংকার হল বিনয় বা নম্রতা।’১৩
উত্তম আচরণ এবং সদা হাসি-খুশী থাকার উপকারও রয়েছে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন : `দয়া ও নম্র ব্যবহার জমিনকে অধিক ফলনশীল করে এবং মানুষের আয়ু বৃদ্ধি করে।’
বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ড. স্যান্ডারসন এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন : `রোগের প্রতিরোধ ও নিরাময়ের ব্যাপারে দয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা উপাদান। অনেক ঔষধ রোগমুক্তির সাথে সাথে অবাঞ্ছিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে,অথচ দয়া স্থায়ী রোগমুক্তি ঘটিয়ে দেহের সকল অংশকে রোগমুক্ত করে। পরোপকারিতা দেহের সকল শক্তিকে প্রভাবিত করে,ভাল আচরণকারীদের রক্ত সঞ্চালন অত্যন্ত চমৎকার এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াও অপেক্ষাকৃত ভাল।’১৪
উত্তম আচরণের গুরুত্ব রয়েছে অনেক বিষয়েই। তা শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে না,বরং এর পাশাপাশি জীবনোপকরণও বৃদ্ধি করে। আলী (আ.) বলেছেন : `সদাচরণ প্রচুর পরিমাণে জীবনোপকরণ বৃদ্ধি এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে বাড়িয়ে দেয়।’
সমাজবিজ্ঞানী এস,মার্দিন তাঁর গ্রন্থে এ কথাগুলো উল্লেখ করেছেন : `আমি এমন একজন রেস্ট্রুরেন্ট ম্যানেজারকে জানি যিনি তাঁর অমায়িক ব্যবহারের ফলে অনেক সম্পদশালী ও জনপ্রিয় হয়েছেন। আমি জানতে পারলাম যে,পর্যটকরা অনেক দূর- দূরান্ত থেকে তাঁর রেস্ট্রুরেন্টে আসত,এজন্য যে,ঐ রেস্ট্রুরেন্টের নির্জনতা ও আনন্দদায়ক পরিবেশ তাদের কাছে অত্যন্ত ভাল লাগত। খদ্দেররা রেস্ট্রুরেন্টে থাকাকালীন ম্যানেজার তাদেরকে এমন সানন্দ সম্ভাষণ জানাতেন,যা তারা আর কোথাও দেখতে পায়নি। বস্তুতপক্ষে অন্যান্য রেস্ট্রুরেন্টে যেখানে অভিযোগের পর অভিযোগ করেও সাড়া পাওয়া যেত না এমন পরিস্থিতি এ রেস্ট্রুরেন্টে কেউ কখনও হতে দেখেনি। এই রেস্ট্রুরেন্টের কর্মচারীরা খদ্দেরদের সাথে স্বাভাবিক ক্রেতা- বিক্রেতার সম্পর্কের ঊর্ধ্বে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলত। কর্মচারীরা অত্যন্ত হাসি-খুশী সহকারে খদ্দেরদের সেবাযত্নের প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদর্শন করত। এ বিশেষ মনোযোগ অতিথিদের প্রতি তাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছার মনোভাব হতে উদ্ভত। কর্মচারীরা তাদের অতিথিদের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলত যা তাদের মধ্যে পুনরায় এখানে আসার আগ্রহ সৃষ্টির মধ্যেই সীমিত থাকত না; বরং তারা তাদের বন্ধুদেরও এখানে নিয়ে আসত।’১৫
ইমাম সাদিক (আ.) প্রফুল্লতাকে মানুষের বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার একটি লক্ষণ হিসাবে গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন : `মানুষের মধ্যে যাদের পরিপূর্ণ যুক্তিজ্ঞান ও বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রয়েছে তারাই হল সর্বোত্তম আচার- আচরণের অধিকারী।’১৬
রাসূল (সা.) বলেন : `সচ্চরিত্র তার অধিকারীকে সারাদিন রোযা রাখা ও সারারাত জেগে ইবাদাত করা ব্যক্তির সমান মর্যাদায় পৌঁছে দেয়।’১৭
উত্তম ব্যবহার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
`আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা রয়েছে,সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে যাবে।’১৮
একদিন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে অপমান করতে লাগল। এ লোকটির নাম ছিল হাসান মুসান্না। ইমাম সাজ্জাদ লোকটির কথার প্রতি গুরুত্ব দিলেন না। লোকটি চলে যাবার পর তিনি তাঁর অনুসারীদের বললেন : `আমি চাই যে,আপনারা আমার সঙ্গে গিয়ে শুনবেন যে,লোকটিকে আমি কী জবাব দেই।’ ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অনুসারীরা তদুত্তরে বললেন : `আমরা আপনার সঙ্গে যাব যদিও আমরা চেয়েছিলাম যে,আপনি বা আমরা লোকটিকে উচিত জবাব দেই।’
ইমাম পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত পড়তে পড়তে লোকটির গৃহাভিমুখে রওয়ানা হলেন :
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّـهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّـهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ
`এবং যারা কোন অশ্লীল কাজ করে বসে অথবা নিজেদের প্রতি অবিচার করে,অতঃপর আল্লাহকে স্মরণ করে নিজেদের গুনাহসমূহের ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ব্যতীত গুনাহ মার্জনাকারী কে আছে? এবং তারা জেনে-বুঝে যা করেছে তার ওপর গোঁয়ারতুমি করে না।’১৯
এ কথা শোনার পর ইমামের সাথীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে,ইমাম সাজ্জাদ (আ.) লোকটিকে কিছু সদয় কথাই বলবেন। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হাসান মুসান্নার বাড়ি পৌঁছলেন এবং বললেন : `তাকে বলুন,এ হচ্ছে আলী ইবনুল হুসাইন।’ লোকটি এ কথা শুনে তাঁর সাথে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। সে নিশ্চিতভাবে মনে করেছিল যে,ইমাম সাজ্জাদ তার কৃত কাজের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এসেছেন। হাসান মুসান্না এসে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম সাজ্জাদ বললেন : `হে আমার ভাই! আপনি আমার কাছ গিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেছেন। আপনি আমার সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তা যদি সত্যই আমার মধ্যে থাকে,আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি,আর যদি এমন কোন বিষয়ে আপনি আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে থাকেন যে ব্যাপারে আমি নিরপরাধ তাহলে আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য ক্ষমা চাইছি।’
লোকটি ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর কথা শোনার পর তাঁর কপাল চুম্বন করল এবং বলল : `প্রকৃতপক্ষে আমি এমন সব বিষয়ে আপনাকে অভিযুক্ত করেছিলাম যে ব্যাপারে আপনি নিরপরাধ। এ কথাগুলোর মধ্যে আমার অবস্থানের বর্ণনাই রয়েছে।’২০
ইমাম সাজ্জাদের কথাগুলো লোকটির অন্তরকে নাড়া দিল ও তা তার ব্যথার উপশম ঘটাল। তার দুঃখ ও অনুশোচনার মনোভাব তার অঙ্গভঙ্গির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হল।

চরিত্র গঠন সম্পর্কিত মতবাদ
চরিত্র গঠন সম্পর্কে দু’ ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। প্রথম মতবাদ হল মানুষের চরিত্র খনির মতো। একে পরিবর্তন করা যায় না। মানুষ যে বংশে জন্মগ্রহণ করে সে বংশের বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে থাকে। অর্থাৎ বংশই মানুষের চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।
দ্বিতীয় মতবাদ : এ মতবাদে বলা হয়েছে যে,মানুষের চরিত্র পরিবর্তন করা যায়। যদি কাউকে যথোপযুক্ত পরিবেশ দেয়া যায় এবং তাকে উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া যায় তাহলে তার চরিত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ বিষয়টি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আর এ মতবাদটিই সঠিক।

মানুষের প্রবৃত্তি
মানুষের প্রবৃত্তি দুই প্রকার। যথা : পাশবিক ও আধ্যাত্মিক।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : `আল্লাহ্ ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন আকল (বিবেক-বুদ্ধি) দিয়ে এবং প্রবৃত্তি ও রাগ দেননি; পশুকে দিয়েছেন প্রথমটি ছাড়া শুধু প্রবৃত্তি ও রাগ,কিন্তু মানুষকে আকল এবং প্রবৃত্তি ও রাগ দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। মানুষ যদি তার প্রবৃত্তি ও রাগকে আকল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে সে ফেরেশতাদের থেকেও উৎকৃষ্ট হতে পারবে।’
মানুষকে তার প্রবৃত্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। প্রবৃত্তির কম ব্যবহারের ফলে তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়,আবার প্রবৃত্তির অধিক ব্যবহারের ফলে সে পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। তাই মানুষকে দৈহিক ও আত্মিক উভয় দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

জিহাদে আকবার (বড় যুদ্ধ)
তাবুকের যুদ্ধ হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর মহানবী (সা.) বললেন : `তাদেরকে আমার শুভেচ্ছা যারা ছোট যুদ্ধ হতে ফিরে এসেছে,কিন্তু বড় যুদ্ধ এখনও বাকী।’ সবাই জিজ্ঞেস করল : `সেটা কোন্ যুদ্ধ?’ তিনি বললেন : `সেটা হল নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’

নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেন বড় যুদ্ধ?
নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বড় যুদ্ধ বলার পেছনে নিম্নের কারণগুলো উল্লেখ করা যায় :
১. মানুষের অস্তিত্বে সবসময় একটি পরস্পরবিরোধী শক্তি কাজ করে : একটি ভাল, একটি মন্দ। তাকে সব সময় মন্দের মোকাবিলা করতে হয়।
২. মানুষের জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই জিহাদ চলে।
৩. এই জিহাদই মানুষের পরিপূর্ণতা লাভের প্রক্রিয়া। কারণ,সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই মানুষ চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়। দ্বন্দ্বের উপস্থিতি না থাকলে বিকাশ সম্ভব নয়।
৪. ছোট জিহাদে অনেক সময় মানুষ গনীমতের মালের লোভে অংশগ্রহণ করে এবং বিজয়ের মাধ্যমে তা লাভ করে। কিন্তু বড় জিহাদে এ সব কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা একেবারেই অমূলক।
৫. এ জিহাদের জয়-পরাজয়ই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে।

সচ্চরিত্রের আলামত
মানুষ নিজের দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধে সব সময় সচেতন থাকে না। তাই যখন সামান্য সাধনা করে বড় বড় পাপকর্ম ছেড়ে দেয় তখন মনে করতে থাকে যে,সে চরিত্রবান হয়ে গেছে। এখন সাধনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু চরিত্রবান হওয়া আসলেই কঠিন কাজ। আর একজন প্রকৃত মুমিন মানেই সত্যিকার চরিত্রবান।
পবিত্র কুরআনে এ মুমিনদের চরিত্রের আলামত সম্পর্কে বলা হয়েছে :
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ﴿١﴾ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ ﴿٢﴾ وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ ﴿٣﴾ وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ ﴿٤﴾ وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ ﴿٥﴾ إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ
`মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে,যারা নামাযে বিনম্র,যারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে,যারা যাকাত দানে সক্রিয়,যারা নিজেদের যৌন অংগকে সংযত রাখে নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসিগণ ব্যতীত...।’২১
অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে :
التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّـهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
`তারা তওবাকারী,উপাসনাকারী,(আল্লাহর) প্রশংসাকারী,তাঁর পথে সফরকারী,রুকুকারী,সেজদাকারী,সৎকর্মের নির্দেশ দানকারী,অসৎ কর্ম হতে নিষেধকারী,আল্লাহর সীমারেখার সংরক্ষণকারী; (হে রাসূল!) বিশ্বাসীদের তুমি (বেহেশতের) সুসংবাদ দাও।’২২
সূরা ফুরকানে মহান আল্লাহ মুমিনদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে :
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63) وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا (64) وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا (65) إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا (66) وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا (67) وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ
`রহমান’ এর বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে,তখন তারা বলে,`সালাম’; এবং তারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দণ্ডায়মান থেকে; এবং তারা বলে,হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত কর,এর শাস্তি তো নিশ্চিত বিনাশ,’ নিশ্চয়ই তা অস্থায়ী ও স্থায়ী আবাস হিসাবে নিকৃষ্ট। এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করেন না,কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। এবং তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না। আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না।...’২৩
যদি মানুষের অবস্থা এ আয়াতগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তবে তার সচ্চরিত্র অর্জিত হয়েছে বুঝতে হবে। আর যদি কোন সঙ্গতি না থাকে,তবে এটি অসচ্চরিত্রের আলামত। রাসূলে কারীম (সা.) মুমিনের অনেক গুণ বর্ণনা করে সচ্চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন :
`মুমিন সে-ই যে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করে,যা নিজের জন্য পছন্দ করে।’
মহানবী (সা.) বলেন :
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন অবশ্যই তার মেহমানকে সম্মান করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন অবশ্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’২৪
মহানবী (সা.) আরও বলেন :
`যাকে পুণ্য কাজ আনন্দিত করে এবং কুকর্ম দুঃখিত করে সেই মুমিন।’
কেউ কেউ সচ্চরিত্রের সকল আলামতকে একত্রে সন্নিবেশিত করেছেন এবং বলেছেন : সচ্চরিত্রবান সেই ব্যক্তি যে অধিক লজ্জাশীল,অধিক উপদেশদাতা,স্বল্পভাষী,অধিক কর্মী,সত্যবাদী,সাধু,গম্ভীর,ধৈর্যশীল,কৃতজ্ঞ,সন্তুষ্ট,সহনশীল,উত্তম সঙ্গী,পুণ্যবান,স্নেহশীল,প্রফুল্ল এবং যে কুভাষী,অপবাদদাতা,হিংসুটে,বিদ্বেষ পরায়ণ ও কৃপণ নয়,শত্রুতা আল্লাহর নিমিত্তেই করে এবং সন্তুষ্টি ও মহব্বতও আল্লাহর ওয়াস্তেই করে। এগুলো দিয়ে সচ্চরিত্রবান বোঝা যায়।

সচ্চরিত্রের সর্বোচ্চ নমুনা রাসূলুল্লাহ (সা.)
রাসূল মিষ্টভাষী ছিলেন এবং ছোট-বড়,ধনী-দরিদ্র সবার সাথে কোমল আচরণ করতেন। রাসূলের কোমলতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলছেন :
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
(হে রাসূল!) আল্লাহর পক্ষ থেকে এ এক অনুগ্রহ যে,তুমি তাদের প্রতি দয়ার্দ্রচিত্ত হয়েছ। যদি তুমি রুক্ষ মেজাজ ও কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে তবে অবশ্যই তারা তোমার চারপাশ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত।২৫
মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করছেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।২৬
আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই বলেছেন :
মহৎ গুণাবলীর পূর্ণতা প্রদান করার জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।২৭
আর মহানবী (সা.)-এর দেয়া প্রতিটি বিষয় গ্রহণ করার জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে :
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।২৮
উপরিউক্ত আয়াত ও রাসূলের বাণী অনুযায়ী আমাদের চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের জন্য রাসূলের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি যাঁদেরকে অনুসরণ করতে বলেছেন তাঁদের শরণাপন্ন হতে হবে। তাঁদের জীবন থেকে আমরা শিক্ষা নেব। তাঁরা যেভাবে চলতে বলেছেন সেভাবে চলব। আর যেভাবে চলতে নিষেধ করেছেন সেভাবে চলা থেকে বিরত থাকব। তবেই আমরা সফলকাম হতে পারব।
নবী (সা.)-এর খাদেম আনাস ইবনে মালিক প্রায়ই বলতেন : আমি দশ বছর নবীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। এ সময়ের মধ্যে আমি যা কিছু করতাম বা না করতাম তিনি আমাকে কখনও উহ্ পর্যন্ত বলেননি।২৯
মহানবী (সা.)-এর জীবনের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন একটি নাজরানী চাদর পরিধান করে পথ চলছিলেন। এক বেদুঈন পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাদর ধরে এমন জোরে টান দিল যে,চাদরের পাড় তাঁর ঘাড়ে বসে গেল। বেদুঈন বলল : `হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আল্লাহর যে সম্পদ আছে তা থেকে আমাকেও দাও।’ রাসূল সেই বেদুঈনের দিকে তাকালেন এবং স্মিত হেসে তাকে কিছু দান করলেন।
যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল তখনও তিনি মহান আল্লাহর কাছে এভাবে দো`আ করতেন :
`হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করুন,তারা জানে না।’
অনেকে বলেন,এ দো`আটি রাসূল (সা.) উহুদের যুদ্ধের পর করেছিলেন।
আর রাসূল (সা.)-এর এসব গুণের কারণেই মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
`নিঃসন্দেহে তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী।’৩০
ইমামদের জীবনেও আমরা তাঁদের উন্নত নৈতিক চরিত্রের অসংখ্য উদাহরণ দেখি। একবার ইমাম আলী (আ.) তাঁর গোলামকে ডাকলেন। সে জবাব দিল না। এরপর তিনি দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার ডাকলেন। কিন্তু গোলামের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি গোলামের কাছে গিয়ে দেখলেন যে,সে শুয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কি আমার ডাক শোননি?’ গোলাম বলল : `শুনেছি।’ তিনি বললেন : `তাহলে কেন জবাব দিলে না?’ গোলাম বলল : `আপনি আমাকে প্রহার করবেন- এ ভয় আমার মোটেই ছিল না। তাই অবহেলা বশত জবাব দিইনি।’ হযরত আলী বললেন : `যাও আমি তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করে দিলাম।’৩১

চরিত্রবান হওয়া ও নিজেকে চেনা
নিজেদের চরিত্রবান করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আমরা আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী আচরণ করব,এটিই স্বাভাবিক। তবে সবসময় আমরা সব কিছু সঠিকভাবে করতে পারি না। আবার অনেক অন্যায় আচরণও করে ফেলি অসচেতনতার কারণে। এগুলো পরিহার করা উচিত। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন রয়েছে নিজেদের চেনার।
প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ধার্মিক ব্যক্তির বাসনা এটি হওয়া উচিত যে,নিজের দোষ সম্পর্কে জেনে নিজেকে সংশোধন করা। নিজের দোষ সম্পর্কে জানার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া যায়। যেমন-
১. আমরা যদি নীতি-নৈতিকতার শিক্ষক বা আলেমগণের শরণাপন্ন হই তবে তাঁরা আমাদের চরিত্রের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করতে পারবেন।
২. নিজের কোন ধর্মপরায়ণ,সত্যবাদী ও জ্ঞানী বন্ধুকে নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা।
৩. শত্রুর মুখ থেকে নিজের দোষ জেনে নেয়া। কেননা,শত্রুরা ছিদ্রান্বেষী হয়ে থাকে। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে,মানুষ এ ব্যাপারে বন্ধুর তুলনায় ছিদ্রান্বেষী শত্রু দ্বারা অধিক উপকৃত হতে পারে। কেননা,বন্ধু খোশামোদের কারণে দোষ প্রকাশ করে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যার বিষয় হচ্ছে মানুষ জন্মগতভাবে শত্রুর উক্তিকে মিথ্যা ও হিংসাপ্রণোদিত জানে; কিন্ত অন্তর্চক্ষুর অধিকারী ব্যক্তিরা শত্রুর কথা দ্বারা উপকৃত হন।
৪. মানুষের সাথে মেলামেশা করে তাদের মধ্যে যে খারাপ দিকগুলো দেখা যায় সেগুলো নিজের মধ্যে আছে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা করা। কেননা,মুমিনরা পরস্পরের আয়না। তাই অপরের দোষ দেখে তারা নিজেদের দোষ জেনে নেয়। তারা জানে যে,সব মানুষের প্রকৃতি কাছাকাছি হয়ে থাকে। যে দোষ একজনের মধ্যে থাকে,তার মূল অপরের মধ্যে থাকতে পারে।
এভাবে আমরা আমাদের দোষ চিনতে পারব। আমাদের মধ্যে একটি প্রবণতা রয়েছে যে,যদি কেউ আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয় তাহলে আমরা তাকে অপছন্দ করা শুরু করি। তাকে নিজের শত্রু বলে মনে করি। এটি মোটেও উচিত নয়। কারণ,অসচ্চরিত্র সাপ বা বিচ্ছুর মত। যদি কেউ আমাদের বলে,তোমার কাপড়ে বিচ্ছু রয়েছে তাতে আমাদের উচিত তার কাছে ঋণী হয়ে ও তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে বিচ্ছুকে কাপড় থেকে আলাদা করে মেরে ফেলা। অথচ কিয়ামতের সেই কঠিন আযাবের মোকাবিলায় একটি বিচ্ছুর কামড় কোন কিছুই না। তাই কেউ আমাদের দোষ ধরিয়ে দিলে তার ওপর আমাদের খুশী হওয়া উচিত। অথচ আমরা খুশী না হয়ে উল্টো সেই ব্যক্তির দোষ অন্বেষণে উঠেপড়ে লাগি। আমাদের আসলে এমন ব্যক্তিকেই বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। ঐ ব্যক্তিকে নয় যে আমার ভাল-মন্দ প্রতিটি কাজের প্রশংসা করবে।৩২

চারিত্রিক ত্রুটি দূর করার উপায়
প্রকৃতপক্ষে চারিত্রিক ক্রটি-বিচ্যুতি হল এক প্রকার মানসিক রোগ। এ রোগ দূর করার জন্য তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত রোগটি কী ধরনের তা নিরূপণ করা। দ্বিতীয়ত রোগের উৎস কোথায় তা নির্ণয় করা। তৃতীয়ত রোগ নিরাময়ের উপায় নির্ধারণ করা।

রোগ নিরাময়ের উপায়
১. ভাল পরিবেশে অবস্থান : পরিবেশের প্রভাবে মানুষ সংশোধিত হতে পারে। মানুষ ভাল পরিবেশ পেলে ভাল হয়ে গড়ে ওঠে আর খারাপ পরিবেশ পেলে উত্তম চরিত্রের ব্যক্তিও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২. সৎ সঙ্গ লাভ : খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করে সবসময় সৎ সঙ্গ লাভের জন্য চেষ্টা করতে হবে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে : `মানুষের দীন তার বন্ধু ও সহগামীর দ্বারাই নির্ধারিত হয়।’
৩. খারাপ পরিবেশ থেকে হিজরত : খারাপ পরিবেশ ছেড়ে ভাল পরিবেশে হিজরত করতে হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
وَمَنْ يُهَاجِرْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يَجِدْ فِي الْأَرْضِ مُرَاغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً
`এবং যে কেউ আল্লাহর পথে হিজরত করবে সে পৃথিবীতে বহু (নিরাপদ) স্থান ও (ধর্মপালন ও কর্মের ক্ষেত্রে) প্রশস্ততা লাভ করবে।’৩৩
আমরা ধারাবাহিকভাবে নৈতিক চরিত্রের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা রাখার চেষ্টা করব। এ প্রবন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কথা বলা বা জিহ্বার ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হল।

জিহ্বার ব্যবহার বা কথা বলা
কারও পরিধেয় পোশাক থেকে মানুষ হয়ত তার সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পেতে পারে,কিন্তু তার সম্পর্কে তাদের চূড়ান্ত অনুভূতি অর্জিত হবে তার কথা বলা থেকে। তাই কথা বলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কথা বলা থেকেই মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
আলী (আ.) বলেছেন :
`মানুষ তার কথার আড়ালে অবস্থান করে।’৩৪
আলী (আ.) বলেন,`হে লোকসকল! মানুষের দশটি গুণ তার জিহ্বা দ্বারা প্রকাশ পায় : ১. সাক্ষী,যে তার ভেতরের বার্তা প্রকাশ করে,২. বিচারক,যে লোকজনের মধ্যে বিচার করে,৩. মুখপাত্র,যে উত্তর প্রদান করে,৪. সুপারিশকারী,যার দ্বারা মনোবাঞ্ছা প্রার্থনা করা হয়,৫. প্রশংসাকারী,যে সবকিছুকে পরিচয় করিয়ে দেয়,৬. নির্দেশদানকারী,যে ভাল কাজে নির্দেশ দেয়,৭. উপদেশদাতা,যে মন্দ থেকে বারণ করে,৮. সমবেদনা প্রকাশকারী,যা দ্বারা দুঃখ-কষ্টসমূহ সহজ হয়। ৯. প্রশংসিত মাধ্যম,যা দ্বারা বিদ্বেষ দূর হয়,১০. মনোহর,যা থেকে কানসমূহ পরিতৃপ্তি লাভ করে।’৩৫
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) কম কথা বলাকে পরিপক্ব বুদ্ধির নিদর্শন বলেছেন। তিনি বলেন :
`যখন আকল পরিপক্ব হবে তখন কথা কমে যাবে।’৩৬
আলী (আ.) আরও বলেন,`জ্ঞানী লোকের জিহ্বা হৃদয়ের পেছনে,আর মূর্খ লোকের হৃদয় জিহ্বার পেছনে।’৩৭
মানুষের সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল কথা বলা। যদি কথা না বলা হয় তাহলে কোন কাজই সম্ভব নয়। মানুষ যেন তার অনুভূতি অপরের নিকট প্রকাশ করতে পারে,একজন আরেকজনের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে এজন্যই ভাষা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমেই মানুষ তার চাওয়া-পাওয়া,তার অভাব-অভিযোগ ব্যক্ত করে। কিন্তু অতি জরুরি এ বিষয়টি সম্পাদনের সময় যদি কোন চিন্তা-ভাবনা করা না হয় তাহলেই যত বিপত্তি ঘটে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন :
`হে মানব! নিশ্চয়ই অধিকাংশ ভুল তোমাদের জিহ্বায় (কথায়)।’
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে : `যে নীরব থাকল,সে নাজাত পেল।’৩৮
কেন এ কথা বলা হয়েছে যে,`অধিকাংশ ভুল তোমার জিহ্বায়’? কারণ,এর ব্যবহার যেহেতু ব্যাপক তাই এতে ভুলের পরিমাণও ব্যাপক। আর এজন্যই সংযত হয়ে কথা বলার জন্য বা কম কথা বলার জন্যই উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু ভাল কাজের জন্য কথা বলাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন :
`জিহ্বাকে রক্ষা কর ভাল ছাড়া,তাহলে তুমি শয়তানের ওপর বিজয়ী হবে।’
আলী (আ.) বলেন,`হে লোকসকল! যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না,সে অনুতপ্ত হয়।’৩৯
ইমাম গাজ্জালী বলেছেন : `বিশটি গুনাহের কারণ হল কথা বলা। আর এগুলো হল :
১. এমন কোন বিষয়ে কথা বলা যে বিষয়ে জ্ঞান নেই
২. অযথা কথা বলা
৩. কোন বাতিল বিষয় নিয়ে কথা বলা
4. তর্ক করা
৫. ঝগড়া করা
৬. বানিয়ে বা অতিরঞ্জিত কথা বলা
৭. অশোভন শব্দ উচ্চারণ করা
৮. অভিশাপ দেয়া
৯. হারাম গান বা কবিতা পাঠ
১০. অতিরিক্ত ঠাট্টা করা
১১. ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও পরিহাস করা
১২. গোপন কথা ফাঁস করে দেয়া
১৩. মিথ্যা ওয়াদা করা
১৪. মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কসম করা
১৫. পরনিন্দা করা
১৬. কথা লাগানো (চোগলখুরী করা)
১৭. নিফাক (দুই রকম কথা বলা)
১৮. অপাত্রের প্রশংসা
১৯. কোন বাছ-বিচার ছাড়া বা হিসাব ছাড়া কথা বলা
২০. এমন কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা যা তার নিজের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় অথবা অযথা প্রশ্ন করা।
আল্লামা মাকারেম শিরাজী এগুলোর সাথে আরও দশটি বিষয় যোগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে : ১. অপবাদ দেয়া
২. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া
৩. আত্মপ্রশংসা করা
৪. অশ্লীল কথা ছড়ানো ও গুজব রটানো
৫. রূঢ় কথা বলা
৬. অযথা পীড়াপীড়ি করা
৭. আক্রমণাত্মক কথা বলা
৮. এমন কারো নিন্দা করা যে নিন্দিত নয়; নন্দিত
৯. অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলা
১০. বাতিলের প্রসার করা
শুধু মুখের ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে এতগুলো খারাপ কাজ সংঘটিত হয়। তাই আমাদের কথা বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজন রয়েছে।

নীরবতা অবলম্বন
এতে কোন সন্দেহ নেই যে,ভাষা মানুষের জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিরাট সম্পদ। ভাষা একের সাথে অন্যের যোগাযোগের মাধ্যম। এটি জ্ঞানের প্রচার ও মানুষকে হেদায়াত করারও মাধ্যম। মহান আল্লাহর ভাষার দ্বারা অন্যান্য পশুপাখি হতে মানুষকে পৃথক করেছেন। আল্লাহ তা`আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন :
الرَّحْمَنُ (1) عَلَّمَ الْقُرْآنَ (2) خَلَقَ الْإِنْسَانَ (3) عَلَّمَهُ الْبَيَان
`তিনি রহমান,কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন,মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন।’৪০
কিন্তু যদি মানুষ তার ভাষাকে নিরর্থক কথা,মিথ্যা কথা,তর্ক-বিতর্ক করা,গালিগালাজ করা,উপহাস ও বিদ্রূপ করা,গীবত করা,দোষারোপ করা,রটনা করা,প্রভৃতি থেকে সংরক্ষিত না রাখে তাহলে তা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। সেজন্য পণ্ডিতগণ আমাদের কেবল দরকারি ক্ষেত্রে কথা বলার উপদেশ দিয়েছেন,নইলে চুপ থাকতে বলেছেন। আর এজন্যই হাদীসে বলা হয়েছে : `যে নীরব থাকল,সে নাজাত পেল।’

কথার প্রকারভেদ
উপকারিতা ও অপকারিতার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের কথাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. সম্পূর্ণ উপকারী কথা
২. সম্পূর্ণ অপকারী কথা
৩. উপকারী ও অপকারীর মিশ্রণ
৪. উপকারী অপকারী কোনটিই নয়।
ওপরের চারটি ক্ষেত্রের তিনটিতে নীরবতা অবলম্বন করার প্রয়োজন রয়েছে। যেক্ষেত্রে আমরা কথা বলব সেক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত যেন আমাদের কথা কপটতা,কৃত্রিমতা ও বাহুল্যকথন দ্বারা কলুষিত না হয়।
ইসলাম নীরবতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন :
`মহান আল্লাহ তাঁর ওই বান্দার ওপর রহম করুন যে ভাল কথা বলে। সে পুরস্কার পাবে। আর যে নীরবতা অবলম্বন করে সে নিরাপদ থাকে।’
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হযরত দাউদ (আ.) সম্পর্কে কথা প্রসঙ্গে বলেন : `তিনি তাঁর সন্তানকে বলেছিলেন : হে আমার সন্তান! যদি কথা বলাকে রূপার তৈরি বলে বিবেচনা কর,তাহলে নীরবতা সোনার তৈরি।’৪১
ইমাম রেজা (আ.) বলেন : `প্রজ্ঞাবানের বৈশিষ্ট্য হল ধৈর্য,জ্ঞান ও নীরবতা। নীরবতা প্রজ্ঞার অন্যতম দিক। মানুষের ভালবাসা অর্জন ও বেহেশত লাভের জন্য নীরবতা একটি মাধ্যম অথবা প্রতিটি ভাল কাজের কারণ হল নীরবতা।’৪২
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,`নীরবতা হল পণ্ডিতদের মূলমন্ত্র। এটি তাদের মূলমন্ত্র যারা অতীত মানুষের জীবন নিয়ে গবেষণা করে এবং যথাযথ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। নীরবতা ইহকালে ও পরকালে উভয় জগতের সুখের চাবিকাঠি। এটি ভুলের প্রতিষেধক। মহান আল্লাহ একে অজ্ঞের জন্য চাদর এবং জ্ঞানীর জন্য অলংকার করেছেন।’
তিনি আরও বলেন : `...তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখ যতটা সম্ভব,বিশেষ করে যখন তুমি আল্লাহ সম্পর্কে কথা বল যা আলোচনা করার জন্য উপযুক্ত শ্রোতা না পাও। এটি বলা হয় হয় যে,রবী ইবনে খাশিম সবসময় একখণ্ড কাগজ তাঁর সামনে রাখতেন এবং সারাদিন যেসব কথা তিনি বলতেন সেগুলো সেখানে লিখতেন। রাত্রিবেলা তিনি এগুলো সতর্কতার সাথে মূল্যায়ন করতেন। তারপর তিনি বলতেন : যে নীরব ছিল সে এখন নিরাপদ। মহানবী (সা.)-এর কিছু সংখ্যক সাহাবী তাঁদের মুখের মধ্যে পাথর পুরে রাখতেন। তাঁরা এগুলো তাঁদের মুখ থেকে তখনই বের করতেন যখন তাঁরা মহান আল্লাহর কথা বলতেন এবং আল্লাহর জন্যই কথা বলতেন।’৪৩
সুতরাং নীরবতা ও কথা বলা যথাক্রমে মানুষের মুক্তি ও ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
তবে কথা বলা ও নীরব থাকারও ক্ষেত্র রয়েছে। যেখানে কথা বলা প্রয়োজন সেখানে চুপ থাকা উচিত নয় এবং যেখানে চুপ থাকা প্রয়োজন সেখানে কথা বলা ঠিক নয়। ইরানের বিখ্যাত কবি আমীর খসরু তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন :
`প্রতিটি কথা বলার মুহূর্ত সুখকর
কিন্তু কখনও কখনও নীরবতা আরও মধুর
মুখ বন্ধ রাখা যেন দুশ্চিন্তার দরজা বন্ধ করা,
কারণ,এ পৃথিবী ভাল ও মন্দের গর্ভধারিণী।
কথা বলার জন্য অনুতাপকারী অনেককে আমি দেখেছি
কিন্তু নীরব থাকার জন্য কাউকে অনুতাপ করতে দেখিনি।
বলার চেয়ে শোনা ভাল যদি তুমি চিন্তা কর
দ্বিতীয়টি করে শূন্য যেথায়,প্রথমটি করে পূর্ণ।
যতক্ষণ না তুমি তোমার বক্তব্যের উপযুক্ততা সম্পর্কে হচ্ছ সুনিশ্চিত
কথা বলার জন্য মুখ খোলা নয় কো তোমার উচিত।’
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : `নীরবতা ও কথা বলার মধ্যে কোনটি উত্তম।’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন : `কথা বলা ও নিশ্চুপ থাকা- উভয়েরই বিশেষ বিশেষ বিপর্যয়কর ক্ষেত্র রয়েছে। কথা বলা নীরব থাকার চেয়ে উত্তম যদি বক্তা তার কথা বলার পর নিরাপদ থাকে।’ তারা জিজ্ঞাসা করল : `কীভাবে এটি সম্ভব?’ তিনি বললেন : `মহান আল্লাহ তাঁর নবী ও মহৎ ব্যক্তিদের নীরব থাকার জন্য প্রেরণ করেননি। তিনি তাঁদের ভাষা ব্যবহারের জন্য প্রেরণ করেছিলেন এবং মানুষ কেবল নীরব থাকার জন্য বেহেশতে প্রবেশ করবে না। আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতাও নীরবতার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে না। নীরবতা দ্বারা আগুন নেভানো যায় না। এসব কাজ কেবল কথা বলার মাধ্যমেই সম্ভব। আমি সূর্যকে চাঁদের সমান বিবেচনা করব না।’৪৪

অধিক কথা বলা বা বাচালতা
স্বাভাবিকভাবেই যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে সে সারাদিন কী কথা বলল তার মূল্যায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় পায় না। আর এজন্যই তার কথা ভিত্তিহীন ও ভুল হয়। শ্রোতারা বিরক্ত হয় এবং বক্তা তার কথার বলিষ্ঠতা হারায়।
ইমাম আলী (আ.) এ ব্যাপারে বলেছেন : `অধিক কথা বলা একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে বিপথগামী করতে পারে এবং একজন ধৈর্যশীল ব্যক্তিকে হতাশাগ্রস্ত করে। সুতরাং অধিক কথা বল না,তাহলে তুমি যেমন মানুষকে পীড়া দেবে তেমনি মানুষও তোমাকে অসম্মান করবে।’৪৫
তিনি আরও বলেন : `বাচালতা পরিহার কর। কারণ,তা তোমার ভুল ও একগুঁয়েমি বৃদ্ধি করে।’৪৬
হযরত ঈসা (আ.) বলেছেন : `তোমার কথাকে সোনার মত (মূল্যবান) মনে করবে এবং কথা বলার উপযুক্ত সময় বেছে নেবে যেমন তুমি তোমার সোনা ব্যয়ের জন্য উপযুক্ত জিনিসকে বেছে নাও।’
সুতরাং আমাদের অধিক কথা বলা পরিহার করতে হবে। আর কথা বলার সময় এ বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে : সব সময় উপকারী ও সত্য কথা বলতে হবে এবং সে কথাই বলা প্রয়োজন যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয়; কারও মনে আঘাত দিয়ে কোন কথা না বলা,এমনকি ঠাট্টাচ্ছলেও কারও অনুভূতিতে আঘাত না করা; পশ্চাতে কারও নিন্দা না করা; যারা অপরের নিন্দা করে তাদের কথা না শোনা; কখনও গালি-গালাজ না করা এবং যে ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে না যে,কথা বলা উচিত কিনা,সেক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকাই কল্যাণকর। যদি কেউ কোন কথা বলে,তা ভাল-মন্দ যা-ই হোক না কেন,কখনই উদ্ধতভাবে জবাব দেয়া উচিত নয়; বরং তাকে তা বুঝিয়ে বলতে হবে।
তথ্যসূত্র
১. ওয়াসায়েল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২১
২. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৫৫৯৪
৩. প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৫৬০০
৪. তুহাফুল উকুল
৫. তুহাফুল উকুল
৬. মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত, জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত নাহজ আলবালাঘা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ১০
৭. নাহজ আল ফাসাহা, পৃ. ৩৩১
৮. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৫৬৯১
৯. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সুনান ইবনে মাজা, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৩৬৮৯
১০. প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৩৬৮৭
১১. প্রাগুক্ত, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৩৭১৬
১২. বিহারুল আনওয়ার, ১৮তম খণ্ড, ৪র্থ অধ্যায়, হাদীস নং ২
১৩. প্রাগুক্ত, ৭৫তম খণ্ড, ৫১তম অধ্যায়, হাদীস নং ১১
১৪. ডন পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত আল্লামা সাইয়্যেদ মুসাভী লারী প্রণীত আত্মসংশোধন ও সমাজ সংশোধনের কর্মপন্থা, পৃ. ২৫
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬
১৬. ওয়াসায়েল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০১
১৭. তুহাফুল উকুল
১৮. সূরা হা-মীম আস্-সাজদা : ৩৪
১৯. সূরা আলে ইমরান : ১৩৫
২০. আল্লামা শেখ মুফিদ প্রণীত কিতাবুল ইরশাদ, পৃ. ২৫৭
২১. সূরা মুমিনূন : ১-৬
২২. সূরা তাওবা : ১১২
২৩. সূরা ফুরকান : ৬৩-৬৮
২৪. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৫৬৯৯
২৫. সূরা আলে ইমরান : ১৫৯
২৬. সূরা আহযাব : ২১
২৭. ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক, ২য় খণ্ড, রেওয়ায়েতনং ৮
২৮. সূরা হাশর : ৭
২৯. ফাযায়েলে খামসাহ্, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৯
৩০. সূরা কালাম : ৪
৩১. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত, ইমাম গায্যালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড, পৃ. ২৬৫-২৭২
৩২. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৭-২৫৯
৩৩. সূরা নিসা : ১০০
৩৪. মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত, জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত নাহজ আলবালাঘা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ১৪৮
৩৫. তুহাফুল উকুল
৩৬. মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত, জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত নাহজ আলবালাঘা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ৭১
৩৭. প্রাগুক্ত, বাণী নং ৪০
৩৮. বিহারুল আনওয়ার, ৭৭তম খণ্ড
৩৯. তুহাফুল উকুল
৪০. সূরা রহমান : ১-৪
৪১. উসূলে কাফী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৪
৪২. প্রাগুক্ত
৪৩. মিসবাহুশ শারীয়াহ
৪৪. বিহারুল আনওয়ার, ৭১তম খণ্ড, পৃ. ২৭৪
৪৫. গুরারুল হিকাম
৪৬. প্রাগুক্ত

No comments:

Post a Comment