Pages

Monday, April 10, 2017

বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বাঙ্গালীয়ানা


আমি বাংলা কিংবা বাঙ্গালী সংস্কৃতির গবেষক নই। কিন্তু নিজ দেশ বা সংস্কৃতির প্রতি উদাসীনও নই। তবে ইদানিং যেভাবে ও যে আঙ্গিকে বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে তাতে কিছু বিষয়ের হিসাব আমি এখনো মিলাতে পারিনি। আপনারা  হয়তো বলতে পারবেন –

১. বাঙ্গালী সংস্কৃতির ছাত্র-গবেষক সবাই দাবী করেন আমাদের সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো। কিন্তু-
ক. ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫)  ছায়ানট সর্বপ্রথম ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’- এ গানের মাধ্যমে নতুনরূপে বর্ষবরণ শুরু করে।

খ. সর্বপ্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে। পরে ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে।

গ. এবারই, ২০১৭ সালে, পশ্চিমবঙ্গে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।

মন্তব্য: তাহলে কি ধরে নেওয়া যায়, বর্ষবরণের এই নতুন রূপ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙ্গালী সংস্কৃতি নয়, অন্তত হাজার বছরের সংস্কৃতি তো নয়ই। নয়ত, আমাদের সংস্কৃতিই হাজার বছরের পুরনো নয়। নতুবা আমরাই শুধু বাঙ্গালী, পশ্চিমবঙ্গের লোকজন নয়।

২. বর্ষবরণের অনুষঙ্গ হিসেবে এখন প্রচলিত হচ্ছে পান্তা-ইলিশ আর পোষাক।

মন্তব্য: আসলেই কি পান্তা ইলিশ আমাদের সংস্কৃতি? বিশ-ত্রিশ বছর আগেও ইলিশ স্থানীয় বাজারে দেখা যেত কালেভদ্রে [১৯৭২ সাল পর্যন্ত ইলিশ আহরণ প্রধানত পদ্মা, মেঘনা, করতোয়া, রূপসা, শিবসা, পায়রা ইত্যাদি নদীর উজানেই সীমাবদ্ধ ছিল (বাংলাপিডিয়া)]।

তাহলে ইলিশ সারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি হয় কিভাবে? কেন পান্তা-আর আলু ভর্তা, মরিচ ভর্তা কিংবা অন্য কিছু নয়? আরো একটা বিষয় স্মর্তব্য, কমবেশি জানুয়ারী থেকে এপ্রিল হচ্ছে জাটকার সময়, দেশের আইনে যা ধরা নিষেধ। বর্ষবরণে এই অনুষঙ্গ তাই কতটুকু বাস্তবসম্মত?

এবার আসি, পোষাকে। পুরুষদের বেলায় পাঞ্জাবী-পায়জামা, আর নারীদের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। অবশ্য উৎসব পার্বণে পোষাক পরিচ্ছদে নারীদের আগ্রহ বেশি। বাংলাদেশের কোথায় লাল পেড়ে সাদা শাড়ি প্রচলিত আমি জানিনা। অন্তত আমি আমার এই জীবনে দেখিনি। শুধু বৈশাখ এলেই বর্ষবরণের নামে এটা পড়া হয়, অথচ বিশ বছর আগেও তা ছিল না।

৩. মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে  নানা মূর্তি, প্রতিকৃতি; যেমন- পাপেট, ঘোড়া, হাতি (১৮৮৯); বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম (১৯৯১); বিরাট আকারের কুমির (১৯৯২); বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া (১৯৯৩) ইত্যাদি। তাছাড়া কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ, রং বেরংয়ের পোশাকে বিচিত্র সাজসজ্জা, আর বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য।

মন্তব্য: এর কোনটা বাংলাদেশের সাথে জড়িত। যদি একান্তই আমাদের দেশকে তুলে ধরতে হয় তাহলে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, নিদেনপক্ষে মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি কেন নয়? তাছাড়া দৈত্য-দানব, রাক্ষস ইত্যাদি কিরূপ বিজ্ঞানসম্মত চেতনা; এদের নিয়ে কিভাবে আনন্দ করা যায়? কিংবা মঙ্গল আহ্বান করা যায়, আমি বুঝিনা।

পরিশেষে, বর্ষবরণের বিরোধিতা হুজুরগণ করবেনই তাতে আর বলার কি আছে? ইসলাম কি বলেছে তা আর এখানে নাই বা বললাম (আসলে বলার কিছু নেই ও, কেননা মূর্তি নিয়ে মিছিল, অশ্লীলতা আর পর্দাহীনতার বিধানে কোন দ্বিমত কোন ওলামাই কোনকালে করেননি)।

কিন্তু যদি আসলেই আমরা বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে ভালোবাসি তাহলেও চিন্তার বিষয়- আমরা যা করছি তা কি আমাদের সংস্কৃতি? এগুলো কি আমাদের কালচারকে প্রতিনিধিত্ব করে? নাকি গত দু’তিন দশকে কতিপয়, হ্যাঁ মুষ্টিমেয় কতিপয়, সুশীলদের চাপিয়ে দেওয়া কিছু অনুষ্ঠানকে আমরা পালন করে নতুন করে বাঙ্গালী সাজছি?

একটু নিজেকে প্রশ্ন করি, ত্রিশ বছর আগেও কি এ দেশে এমন ছিল? নাকি আরও অতীতে ছিল? আমার জানামতে, মেলা, নৌকা বাইচ, কুস্তি খেলা, যাত্রাপালা, হালখাতা ইত্যাদি ছিল নতুন বর্ষের অনুষঙ্গ। আজ হঠাৎ করে কিভাবে (ও কেন) আমাদের সংস্কৃতি পরিবর্তিত হল? তাও শুধু ঢাকায়? (সম্ভবত ঢাকাতেই শুধু বাঙ্গালীদের বাস)।

জানিনা, আমরা জনগণ, কিছুই জানিনা। কিন্তু এটা জানি, বাঙ্গালীদের হুজুগেপনার ভালো সদ্ব্যবহারই হচ্ছে এসব কাজে। ত্রিশ বছরে যদি আমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পরিবর্তন হতে পারে, তাহলে আমরা আশাবাদী। সামনের ত্রিশ বছরে হয়ত আমরা সত্যিকারের ভালো কোন অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করব। যাতে কল্যাণ হবে সবার, গরীব-দুঃখী, ধনী নির্ধন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার; মুসলিমরাও সেদিন নিশ্চয়ই বিরোধিতা করবেন না। আমরা চাইলেই সম্ভবত তা করতে পারি।
লেখক:  মুস্তাফা মনজুর, সহকারী অধ্যাপক, ঢা.বি.
Source: বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বাঙ্গালীয়ানা

No comments:

Post a Comment