Pages

Wednesday, March 20, 2013

রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের মৃত্যু


রাষ্ট্রপতির মরদেহ বঙ্গভবনের পথে

রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের মরদেহ হযরত শাহজালাল রহ. আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছে। সেখানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

বিমান বন্দরে রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এর পর রাষ্ট্রপতি মরদেহ বঙ্গভবনের উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
এর আগে রাষ্ট্রপতির মৃত্যু খবরের পরপরই গণভবনে জরুরি বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  বৈঠকে উপস্থিত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা। পরে  ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধাঞ্জলি ও অন্যান্য কর্মসূচি। শুক্রবার দুপুর আড়াটায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে রাষ্ট্রপতির প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুপুর সাড়ে তিনটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নিজ বাসভবন গুলশানের আইভি টাওয়ারে নেয়া হবে। বিকেল পাঁচটায় বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

 

একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিক চলে গেলেন। জাতি হারালো এক কৃতী সন্তানকে। জীবনভর যিনি দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমানের শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সংবাদ শুনে শোকাচ্ছন্ন হয়েছে জাতি। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় বুধবার বিকেল চারটা ৪৭ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

শ্বাসকষ্টজনিত কারণে গত ৯ মার্চ রাতে রাষ্ট্রপতি ঢাকা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক (সিএমএইচ) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।  পরে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ১০ মার্চ রাতে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়।

১১ মার্চ সকালে তাকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

মোঃ জিল্লুর রহমান ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মেহের আলী মিঞা ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও তৎকালীন ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জেলা বোর্ডের সদস্য।
জিল্লুর রহমান ময়মনসিংহ জেলা শহরে তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে ভৈরব কেবি হাই স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জনাব জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই ২১শে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেখানে জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং একই সাথে তার মাস্টার্স ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় তার মাস্টার্স ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয়।

তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র থাকাকালে সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন।

মো. জিল্লুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় দখলদার পাকিস্তান সরকার তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদণ্ড প্রদান ও তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।

১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেন। ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি মহান জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি আইন জারির পর ওই বছরের ১৬ জুলাই রাতে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফতার হলে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দল পরিচালনা করেন। দীর্ঘ ১১ মাস শেখ হাসিনার জেলজীবন এবং চিকিৎসার জন্য আরো প্রায় ছয় মাস দেশের বাইরে অবস্থানকালে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ জিল্লুর রহমান দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল অবদান রাখেন এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অবিস্মরণীয় বিজয় লাভ করে। এই নির্বাচনে তিনি ষষ্ঠ বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জনাব জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রথম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর প্রায় চার বছর মোঃ জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য থাকাকালে মোঃ জিল্লুর রহমান আবারো কারাবরণ করেন। ১৯৯২ এবং ১৯৯৭ সালে দলীয় কাউন্সিলে জিল্লুর রহমান পর পর দুইবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।

জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী বিশিষ্ট নারী নেত্রী বেগম আইভী রহমান ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর নারকীয় গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে দু’দিন পর মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী এবং জাতীয় মহিলা সংস্থার সাবেক চেয়ারপারসন আইভি রহমান গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
জিল্লুর রহমান ছিলেন এক পুত্র এবং দুই কন্যার জনক।



শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে নামাজে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে  রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে।

বুধবার রাতে আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পদক মৃণাল কান্তি দাস স্বক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির মরদেহ গ্রহণ করা হবে। সেখান থেকে বেলা সাড়ে ১২টায় শোভাযাত্রাসহ মরদেহ নেয়া হবে বঙ্গভবনে। সেখানে দুপুর দেড়টার সময় মরদেহ সামনে রেখে রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দেয়া হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে দুইটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি, সংসদ সদস্য, ডিন অব ডিপ্লোমেটিক কোর ও কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণীপেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা জানাবেন। বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন এবং সর্বসাধারণ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রাষ্ট্রপতির মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হবে। সেখানে জানাজা পর্যন্ত তার মরদেহ সংরক্ষণ করা হবে।

পরদিন শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে রাষ্ট্রপতির জানাজা সম্পন্ন হবে। এরপর বেলা সাড়ে তিনটায় বনানী কবরস্থানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে।


 
রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে আগামী তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।

বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিল নতুন বার্তা ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় বুধবার বিকেল চারটা ৪৭ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ইন্তেকাল করেন।

No comments:

Post a Comment